Business Care News

Business News That Matters

BusinessCare.news, Editorial Banner

সংকটপূর্ণ ‌অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ৫৪ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পে গ্রহণ কতটা যুক্তিযুক্ত?

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রেখেছে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প। বেশ কয়েকটি অবকাঠামো প্রকল্প প্রকৃত পক্ষেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গতিশীলতা এনেছে এবং সেগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু সফল কয়েকটি অবকাঠামো প্রকল্পের অনুপ্রেরণায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় একের পর এক বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। এতে দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২ বছরে বাংলাদেশের ঋণ আড়াই গুণের বেশি বেড়েছে। তাদের ওয়ার্ল্ড ডেট রিপোর্ট বা বৈশ্বিক ঋণ প্রতিবেদন ২০২৩-এর তথ্যানুসারে, ২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৭ দশমিক শূন্য ১২ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৭১২ কোটি ডলার; ২০২১ সালে যা ছিল ৯১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ১৪৭ কোটি ডলারের বেশি। সেই হিসাবে এক বছরে বাংলাদেশের বিদেশী ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি। ২০২১ সালে বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সম্মিলিত বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ৯ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার। ২০২২ সালে ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৯ ট্রিলিয়ন বা ৯ লাখ কোটি ডলারে। অর্থাৎ এ সময়ে সম্মিলিতভাবে এসব দেশের বিদেশী ঋণ কমেছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

বিশালাকার ঋণভার, প্রবাসী আয় সংকোচন, রিজার্ভ হ্রাসসহ বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায় মূল্যস্ফীতি এক বছর ধরেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এদিকে বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাবে একের পর এক পণ্যের দাম হঠাৎ করেই বেড়ে যাচ্ছে। শুরুতে অস্বীকার করার প্রবণতা থাকলেও সরকারের উচ্চ মহল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরসহ অনেকেই বলছেন, দেশ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সে সংকট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ সে আকারে আসছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফের ঋণ দিয়ে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি সাময়িকভাবে মোকাবেলা করা গেলেও অন্যান্য সংকট মোকাবেলা সম্ভব নয়। দেশের আর্থরাজনৈতিক পরিবেশ যখন এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তখন বেশ কয়েকটি বড় আকারের প্রকল্পের ভবিষ্যৎ হুমকিতে পড়েছে। 

 , দেশের এ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ৫৪ হাজার কোটি টাকার ‘মেট্রোরেলের লাইন-৫ (দক্ষিণ)’-এর মতো মেগা প্রকল্পটি গ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়ে কাজ করছে পরিকল্পনা কমিশন। সম্প্রতি এ বিষয়ে কমিশন একটি পর্যালোচনা সভাও করেছে। রিজার্ভের বর্তমান অবস্থা, টাকার বিপরীতে ডলারের উত্থান, বিদেশী ঋণ পরিশোধের আসন্ন চাপ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকল্পটি দু-এক বছরের জন্য পিছিয়ে দেয়া যায় কিনা সে বিষয়ে আলোচনা হয় বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।

তাড়াহুড়ো করে এত বড় প্রকল্প নেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরাও। আগামী অর্থবছর থেকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ফলে বড় প্রকল্পের জন্য নতুন করে নেয়া ঋণ অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে বলে তাদের আশঙ্কা। তবে ঋণের ক্ষেত্রে সহজ শর্ত এবং তা পরিশোধে দীর্ঘ সময় নিশ্চিত করা গেলে প্রকল্পটি হাতে নেয়া যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন কেউ কেউ। 

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, পাতাল ও উড়াল মিলিয়ে মোট ১৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন রুট)। এর মধ্যে রাজধানীর গাবতলী থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার পাতাল ও আফতাবনগর থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত চার কিলোমিটার হবে উড়ালপথ। ২০২৪ সালের প্রথম দিকে কাজ শুরু হয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার পরিকল্পনা সরকারের। এ রুট নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৪ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ১৫ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। ৩৯ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা নেয়া হবে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে। এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা এবং বাকি ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক থেকে নেয়া হবে। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের কারণে মেট্রোরেলের এ পথের নির্মাণকাজ শুরু হতে কিছুটা দেরি হলেও এখনো তা সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। প্রকল্পটির নকশা তৈরিতে এরই মধ্যে সরকার অনেক টাকা ব্যয় করেছে। জানুয়ারিতে ঠিকাদার বাছাই করতে অগ্রিম টেন্ডারিংয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। জমি অধিগ্রহণের জন্য সব নকশাও ঠিক করা হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সবল থাকা, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ সচল থাকা ও তৈরি পোশাকের রফতানি চাঙ্গা থাকায় একের পর এক প্রকল্প হাতে নিচ্ছিল সরকার। কিন্তু মাঝখানে কভিড-১৯ মহামারী, গত বছর শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পুরো বিশ্ব অর্থনীতিই নানা সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। অনেক দেশ সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও বাংলাদেশ পারছে না। ২০২১ সালের আগস্টে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছিল। আশা করা হচ্ছিল, এ সময়ে এসে ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে রিজার্ভ। অথচ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রায় প্রতি মাসে ১/২ বিলিয়ন ডলার করে কমছে রিজার্ভ। এমন পরিস্থিতিতে বড় অংকের অর্থ ব্যয় করে শ্বেতহস্তী প্রকল্প নেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। 

বৈদেশিক ঋণে নেয়া বেশির ভাগ প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে উদারহস্ত দেখা যায়। নিজস্ব সক্ষমতা দুর্বল থাকার কারণে প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মী নিয়োগ ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে বড় অংকের অর্থ ব্যয় হয়। এমআরটি-৫ প্রকল্পটির ৭০ শতাংশের বেশি অর্থ ব্যয় হবে যন্ত্রপাতি আমদানিতে। এর বাইরে পরামর্শক ব্যয় রয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মতো। দেশের ডলার সংকটের মধ্যেই ওই বিদেশী পরামর্শকদের সম্মানীও ডলারেই পরিশোধ করতে হবে। যদি প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে হয় তাহলে বৈদেশিক ঋণের বাইরেও ডলারের চাহিদা মেটাতে সরকারকে রিজার্ভে হাত দিতে হবে। এর মধ্যে আবার আগামী বছর থেকে বিদেশী ঋণ পরিশোধের একটি চাপ শুরু হবে। অন্যদিকে ডলারের দাম বাড়লে প্রকল্প ব্যয় আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই মেট্রোরেলের চলমান দুটি প্রকল্প শেষ হওয়ার পর নতুন প্রকল্পটি নেয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখতে পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে যে পরামর্শ এসেছে তা আমলে নিতে হবে।

Skip to content