অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে দেশের ব্যাংক খাতে। সুশাসনের ঘাটতি, ডলার সংকট লাগামহীন খেলাপি ঋণও সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার ফলে সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে ব্যাংকগুলো। দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাওয়ার অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে আত্মসাৎ করা হয়েছে হাজার কোটি টাকা। ফলে তারল্য সংকটসহ নানামুখী জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। দেশের গণমাধ্যমগুলো দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাত নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সতর্কতামূলক সংবাদ প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ব্যাংক খাত এ অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
২০০৮-২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে ব্যাংক খাত থেকে লোপাট হয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এ সময়ে ভুয়া কাগজপত্র ও অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে ঋণসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ লোপাটসহ ব্যাংক খাতে নানা ধরনের আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৩-২৪: চলমান সংকট ও করণীয়’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য উঠে আসে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা গেছে, ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে লোপাট করা অর্থ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি। এ অর্থ দিয়ে অনায়াসে বাজেট ঘাটতি মেটানো সম্ভব হতো। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত আরো দুর্বল হচ্ছে। এ খাতের নীতিমালাকে প্রভাবিত করতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ প্রাধান্য পায়। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ব্যাংক খাত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না। কিছু ব্যক্তিস্বার্থের কাছে খাতটি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ ব্যাংকের পর্যাপ্ত মূলধন নেই। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অবস্থা শোচনীয়। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরো করুণ।
ব্যাংকে যে টাকা জমা থাকে, সেটি জনগণের টাকা। এ টাকা ব্যয়ের খাত অবশ্যই সুবিবেচনার বিষয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক খাতে নিয়ম-কানুন বাস্তবায়ন ও সংস্কার খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে বলে সংস্থাটির দাবি। বস্তুত ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়ম-কানুন ও নীতিমালা আছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন দেখা যায় না। এমনকি যথাযথ পরিদর্শন, পরিবীক্ষণও হয় না। ঋণখেলাপির সঙ্গে জড়িতরাই ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের নিয়ম করে দেন। এ রকম বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে উত্তরণে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নীতিমালার বাস্তবায়ন দরকার।
বর্তমানে অর্থনীতি অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারকদের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা প্রধান কাজ হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে সবকিছু যেভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে, তাতে কেবল নিঃস্বার্থ শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষেই সম্ভব অর্থনৈতিক সংস্কারের কঠিন পথে যাওয়া। এর মাধ্যমেই অর্থনীতিকে উদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে।
অর্থনীতিতে এসব চ্যালেঞ্জ নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিচ্ছে। এ সময়ে বিচক্ষণতার সঙ্গে পথ চললে তা দেশের অর্থনীতিকে সঠিক পথে চলতে বাধ্য করবে। তাই কঠিন সময় অতিক্রম করার জন্য শক্তভাবে হাল ধরা প্রয়োজন। এছাড়া প্রয়োজনীয় সংস্কারের পথেও অগ্রসর হওয়া উচিত। বিশেষ করে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে যেন কঠিন কোনো বিপদের মুখোমুখি না হতে হয়, সেজন্য আগাম প্রস্তুতি প্রয়োজন।
অর্থনীতির চার সূচক ব্যাংক খাত , মূল্যস্ফীতি, বহিঃখাত ও শ্রম খাত— এ বড় ধরনের সংকটে রয়েছে এ মুহূর্তে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনা খুব প্রয়োজন। এজন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শক্ত ভূমিকা গ্রহণ করতে।হবে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে হবে। নতুন করে যেন খেলাপি ঋণের বোঝা না চাপে সেজন্য ব্যাংকগুলোরও সতর্কতা প্রয়োজন। সিপিডি ব্যাংক খাত শক্তিশালী করতে খুব দ্রুত অস্থায়ী ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার যে পরামর্শ দিয়েছে তা বিবেচনা করা যেতে পারে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে বৈষম্য বেড়েছে। এটিও বিবেচনা করতে হবে। বৈষম্য হ্রাসের জন্য ধনীদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করে গরিব মানুষের উন্নয়নে তা ব্যবহার করা উচিত। এর অনুপস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিতে দুটো ধারা তৈরি হয়ে গেছে, যা বৈষম্য আরো প্রকট করেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি সম্পদ বণ্টনের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে রফতানি আয়ের তথ্যে গরমিল দেখা যাচ্ছে। এটি অর্থ পাচারের কারণে নাকি রফতানি মূল্যের হেরফেরের কারণে হচ্ছে তা যাচাই করা প্রয়োজন। রফতানির নামে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা বিষয়টি গভীরভাবে অনুসন্ধান করার তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া ডলারের উচ্চ মূল্য পাওয়ার জন্য কারসাজি করা হচ্ছে কিনা সেটিরও খোঁজ নিতে হবে। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। রিজার্ভ থেকেই ঋণ পরিশোধ করায় অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ তৈরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই ঋণের ফাঁদ থেকে সতর্ক থাকতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যাংক খাতে কীভাবে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে, সেটিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, অর্থনীতিতে এখনো ব্যাংকের বিকল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি। তাই ব্যাংক খাত আক্রান্ত হলে তার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে। এজন্য উন্নত দেশগুলোর মতো ব্যাংকনির্ভর লেনদেন ব্যবস্থায় ধাবিত হওয়া প্রয়োজন। এতে অর্থনীতি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পাশাপাশি দুর্নীতি কমে আসবে বলে আশা করা যায়। যথোপযুক্ত পদক্ষেপের ফলে দেশের অর্থনীতি সংকট কেটে উঠবে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা। এজন্য সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে সেটিই সবার কাম্য।
Related Posts
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আন্তর্জাতিক আস্থা তৈরি করতে হবে
পাটপণ্যের রপ্তানিমূল্য মিলের ব্যাংক হিসাবে পাঠানোর নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের
রেমিট্যান্স সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে কি?