প্রশ্নঃ বাংলাদেশে এমএলএম ব্যবসায়ে ডেসটিনি বেশ সফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে। কেউ ইনভাইট করলে কি এই ব্যবসায় হাত দেয়া যাবে? জানালে উপকৃত হবো। [প্রশ্নটি ডেসটিনি নিয়ে সাম্প্রতিক অভিযোগের আগে করা, উত্তরটাও সে সময়েরই। অর্থাৎ যে সতর্কতার কথা কোয়ান্টাম আগেই বলেছে, সময়ের ব্যবধানে তা-ই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে]
উত্তরঃ আপনার প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছে—আপনি যেন একেবারে টাকাপয়সা গুছিয়ে নিয়ে বসে আছেন, কেউ ইনভাইট করামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আসলে পরিশ্রম না করে ফোকটে লাভ করার প্রবণতা থেকে মানুষ এভাবেই বিপদে পড়ে। ফোকটে কখনো কিছু পাওয়া যায় না। আর পেলেও তা কল্যাণ বয়ে আনে না কখনো। আপনি মনে করছেন যে, খুব লাভজনক হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এখন থেকে পাঁচ/ সাত বছর আগে আরেকটি প্রতিষ্ঠান ছিল। আইটিসিএল। সেটাও খুব লাভজনক দেখা গিয়েছিল। তারপরে ‘যুবক’ ছিল। সেটাও খুব লাভজনক ছিল। যারা এগুলোর খোঁজখবর রাখে তাদের কাছ থেকে জেনে নেবেন যে, এখন এদের কী অবস্থা।
আগের একটি উত্তরে আমরা বার্নার্ড ম্যাডফ নামে পাশ্চাত্যের একজন প্রতারকের প্রতারণার বিস্তারিত বলেছি। তার প্রতিষ্ঠানে ৬৫ বিলিয়ন ডলার মানে ৬৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছিল। যারা বিনিয়োগ করেছে তার মধ্যে ইউরোপের তিনটি ব্যাংক আছে। নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এরকম কয়েকজন আছেন যারা তাদের নোবেল পুরস্কারের সমস্ত অর্থ তাকে দিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, ম্যাডফের প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক বা বেশ সফল হিসাব দেখেই কিন্তু তারা এ বিনিয়োগ করেছেন। এখন ম্যাডফের কী অবস্থা? মাত্র ১৫০ বছরের জেল হয়েছে! ৬৫ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৬৫০ কোটি ডলার হাওয়া হয়ে গেছে। যতজন যা কিছু বিনিয়োগ করেছিলো তার সবই হাওয়া।
আমি তো শুধু অবাক হই, বিজ্ঞাপনে গাছের ছবি দেখে কতজন টাকা দিয়েছেন! খোঁজ নিয়ে দেখেন কয়টা গাছ আছে। ওরা বলে ১২ বছর পরে ৩০ হাজার টাকা দেবে। আদৌ যদি ১২ বছর পর(!) এই প্রতিষ্ঠান থাকে। আপনি গাছের টাকা নিতে যান, দেখা যাবে যে, একটা গাছের জন্যে ১০০০ লোক গেছে। গাছ চেরাই করতে করতে কাঠ এত চিকন হবে যে, তা দিয়ে হয়তো দাঁত খিলাল করার চেয়ে বেশি কিছু করতে পারবেন না। তাই ফোকটে কিছু পেতে চাইবেন না। পরিশ্রম করবেন, আপনি পাবেন। আমরা বার বার ধোঁকা খাই একটি জায়গায় এসে। আমরা বিনা পরিশ্রমে অথবা নামমাত্র পরিশ্রমে পেতে চাই। আর পতনের আগে সবাইকে সফলই মনে হয়। পতন হলে বোঝা যায় যে, সাফল্য কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এ পর্যন্ত উত্তরটুকু ২০১০ সালে দেয়া যখন এই প্রশ্নকর্তার মতো অনেকেই মনে করতেন, ডেসটিনি একটি সফল ব্যবসা এবং বিনিয়োগের নামে সাধারণ মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দিয়েছে তাদের হাতে। এখন এই ২০১২ সালে এসে কী অবস্থা নিচের খবরগুলোই তার প্রমাণ-
‘দুদকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন : ৫০০০ কোটি টাকার সবই তুলে নিয়েছে ডেসটিনি’ শীর্ষক দৈনিক প্রথম আলো’র ১২ জুন প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, ‘ডেসটিনি গ্রুপের ৩৭টি প্রতিষ্ঠান এবং এর পরিচালক ও স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে জমা হয়েছে ৪,৯৯৬ কোটি টাকা’। এর মধ্যে ৪,৯৭৫ কোটি টাকাই তুলে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো প্রাথমিক প্রতিবেদনসূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ডেসটিনি গ্রুপের ৪৪৩টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। ২৫২টি ব্যাংক হিসাব বর্তমানে বন্ধ। বাকিগুলোতে স্থিতি রয়েছে মাত্র ১৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রুপের প্রধান তিনটি কোম্পানি-ডেসটিনি ২০০০, ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন ও ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের নামে থাকা ২৮১টি হিসাবে স্থিতি রয়েছে মাত্র ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বলা হয়, এসব হিসাব থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ডেসটিনি গ্রুপের (কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম ছিল প্রতিবেদনে যা অপ্রকাশিত রাখা হলো) হিসাবে স্থানান্তরিত হয়েছে।
এর আগে ৩০ মার্চ প্রকাশিত প্রথম আলোর আরেকটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তের বরাত দিয়ে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড প্রসঙ্গে বলা হয়, সমবায় অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নেয়া এই প্রতিষ্ঠানটি জনগণের কাছ থেকে মাসে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে। ৪০ লাখ প্রতিনিধির মাধ্যমে ব্যাংকের মতো রীতিমতো আমানত সংগ্রহ করছে তারা। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হয়েও বিক্রি করছে এর শেয়ার। তথাকথিত শেয়ার বিক্রি করেই প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নিয়েছে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বহুসংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির যোগসূত্র থাকায় অনেক সাধারণ মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিনব মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) পদ্ধতি অবলম্বন করছে তারা। বিনিময়ে আমানত সংগ্রহকারীদের কমিশন দেয়া হচ্ছে, যা অবৈধ ও অনৈতিক। প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়তে পারে এবং প্রতারিত হতে পারে জনগণ।
৩১ মার্চের তথ্য অনুযায়ী ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের মোট সম্পদের পরিমাণ ৩,৩৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে তারা বিভিন্ন প্রমোশনাল কার্যক্রমে ব্যয় দেখিয়েছে ৭১০ কোটি টাকা। এর আগে ২০১০ সালের ৩০ জুন এই প্রতিষ্ঠানের সম্পদ দেখানো হয়েছিল ৭৩১ কোটি টাকা এবং ২০১১ সালের ৩০ জুন ছিল ২,৯৯৯ কোটি টাকা। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে কী করে এত বেশি সম্পদ দাঁড়ালো, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই রিপোর্ট জমা হওয়ার পর, দুদকও সিদ্ধান্ত নেয় অনিয়ম অনুসন্ধানের। প্রায় দুই মাস অনুসন্ধান শেষে গত ২৩ মে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত দল। ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পায় তারা।
বলা হয়, কোম্পানির শীর্ষ ব্যক্তিরা কয়েকশ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে। বিদেশ থেকে কম দামে পণ্য আমদানি এবং দেশের মধ্যে কম দামে জমি কিনে তা গ্রাহকদের কাছে বেশি দাম দেখানো হয়েছে। আর ঐ অতিরিক্ত অর্থ কোম্পানির ব্যাংক একাউন্ট থেকে কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে সরিয়ে নিয়েছে।
সরিয়ে নেয়া অর্থের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমএলএম কোম্পানির ৬৬টি ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৫,৯৬০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে ডেসটিনি। এর মধ্যে ৩,৫৮৮ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
ট্রি প্লান্টেশনের বিভিন্ন প্যাকেজ বিক্রি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে ১৩৩টি ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে ৯২১ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। ঐ অর্থের মধ্যে ৯০০ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। এছাড়া ডেসটিনি মাল্টিপারপাসের নামে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রায় ১,৪৪০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ১,৪১৮ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়।
২২ জুন, ২০১২ বিডিনিউজ ডট কমের এ খবরটা দেখুন—
ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের ঢাকা অফিসগুলোও বন্ধ হচ্ছে— ঢাকায় থাকা তাদের ২৩টি অফিসের পাঁচটি অফিস বন্ধ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। এছাড়া রাজধানীর ২৩টি কার্যালয়ের যোগাযোগের নম্বর এখন বন্ধ। গতকাল দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঐসব নম্বরে ফোন করেছেন গ্রাহকরা। কিন্তু নম্বর বন্ধ থাকায় কারো সঙ্গে তারা যোগাযোগ করতে পারেন নি। এতদিন ওই নম্বরগুলোই দেয়া হতো দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ডেসটিনির বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারীকে। ওদিকে অবৈধ ব্যাংকিং ও আইন বহির্ভূত কর্মকান্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ডেসটিনির অনেকেই গা-ঢাকা দিয়েছেন। এতদিন তাদের যেসব সদস্য সাধারণ মানুষকে রাজধানীতে বহুতল মার্কেট আর দিনে লাখ টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে এসেছেন তাদের তৎপরতাও কমেছে। হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে ডেসটিনির প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও (সেমিনার)।
সুত্রঃ প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড
Related Posts
Q&A Series – Episode 292: Failure is the pillar of success!
Q&A Series – Episode 291: What exactly is visualization?
Q&A Series – Episode 290: How does visualization work?