প্রশ্নঃ আমার ছেলেকে বিয়ে করানোর পর তারা আলাদা হয়ে যায়। আমার স্বামী আগামী মাসে অবসরে যাবে। বৃদ্ধ বয়সে সব ছেলেমেয়ে বউ নিয়ে একসাথে থাকার জন্যে আমার করণীয় কী?
উত্তরঃ এটা খুব কঠিন। আসলে ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে, তার মানে হচ্ছে ছেলেকে আপনি সেভাবে লালন করতে পারেন নি। আমি খুব নির্মম কথা বললাম। ছেলে যদি আপনার চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ হতো, তাহলে সে কখনো বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যেত না। সে বউকে নিজের কাছে, নিজের পরিবারেই রাখতে চাইত। দৃঢ়ভাবে বলত আমি আলাদা হবো না। কিন্তু আপনি আপনার ছেলেকে সেভাবে লালন করতে পারেন নি। ছেলের মধ্যে সেই দৃঢ়তা সৃষ্টি করতে পারেন নি। এখন একসাথে থাকতে চেয়ে তো কোনো লাভ নেই।
অর্থাৎ একটা চারাগাছ যখন বড় হচ্ছে সেই সময় তাকে ঠিক করতে হবে। কিন্তু আমরা করি উল্টোটা। যখন তাকে বাঁকানো যেতে পারে বা সোজা রাখা যেতে পারে সে-সময় আমরা আহ্লাদ করে ছেড়ে দেই। আর যখন সে তার মতো শক্ত হয়ে যায় তারপরে আমরা কান্নাকাটি শুরু করি।
অধিকাংশক্ষেত্রে এটা সত্য, আপনি যা করবেন সেটাই আপনার ওপরে ফিরে আসবে। আপনিও হয়তো আপনার স্বামীকে নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। অথবা আপনি হন নি, আপনার স্বামী আপনাকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। এখন আপনারা যদি আলাদা হয়ে গিয়ে থাকেন তো আপনার ছেলে আপনার থেকে আলাদা হয়ে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক। অবশ্য আপনার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও হতে পারে।
এটা নিয়ে ইউরোপিয়ান একটা গল্প আছে। বাবা-মা, নাতি এবং নাতির দাদা। অর্থাৎ দাদা, ছেলে, ছেলে বউ, নাতি। ডাইনিং টেবিলে খাচ্ছে। দাদা বুড়ো মানুষ, খেতে গেলে অনেক সময় টেবিলের ওপর খাবার পড়ে যায়। এজন্যে তাকে ছোট আলাদা টেবিল দেয়া হয়েছে। যে-কোনোভাবে হোক দাদা-নাতির মধ্যে সম্পর্ক ভালো। এখন দাদা মারা গেছেন। স্বাভাবিকভাবে ঐ টেবিলের আর প্রয়োজন নাই। বাবা যখন টেবিলটা বিক্রি করতে যাচ্ছে তখন ছেলে বলছে, না, এটা তুমি বিক্রি করবে না, এটা আমি রেখে দেবো। বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করছে, তুমি এটা রেখে কী করবে? তখন ছেলে উত্তর দিচ্ছে, তুমি যখন বুড়ো হবে তখন তো তুমি আমাদের সাথে খেতে পারবে না। তখন ঐ টেবিলে তুমি খাবে।
আমরা আগেই বলেছি, ছেলেমেয়েরা কিন্তু মা-বাবার কথা ফলো করে না, তাদের কাজ অনুসরণ করে। কথায় আছে, ‘বাপকা বেটা, সিপাইকা ঘোড়া’। এটা তো এমনি এমনি বলা হয় না। বেটা বাপকে দেখতে দেখতে বাপকা বেটা হয়, বাবার কথা শুনে নয়। অতএব আপনি আপনার মা-বাবার সাথে যেভাবে আচরণ করবেন, আপনার সন্তান সেটাই শিখবে।
এটা এখন থেকে ৫০ বছর আগের কথা। আমি এক পরিবারকে জানি। এক ছেলেকে জানি। তার মা তাদের সাথে থাকতেন। ভদ্রলোক চাকরিজীবী ছিলেন। একদিন হঠাৎ তার মা মারা যান। মায়ের ইচ্ছা ছিল, তার মৃত্যুর পরে তার কবর যেন তার স্বামীর কবরের পাশে হয়। এখন মা মারা গেছেন ঢাকায়। তার গ্রামের বাড়ি দূরে। যেতে হবে নৌকা করে। সদরঘাট থেকে নৌকায় যেতে হবে। যাওয়ার আর কোনো পথ নাই। এখন মায়ের লাশ নিয়ে বুড়িগঙ্গার ঘাটে যাওয়ার পরে কোনো মাঝি আর লাশ নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছে না। সাধারণত লাশের ব্যাপারে অনেকের অনেকরকম ভয় সংস্কার আছে। সে-ও যে লাশ হবে এটা কেউ মনে করে না। একজন বলল যে, ঠিক আছে। আমার নৌকায় নিতে পারি কিন্তু আমি এত নৌকা বাইতে পারব না। যার মা সে বলল ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা নাই, তুমি নৌকায় বসে থাকবে। আমি নৌকা বাইব। সে ছয়-সাত ঘণ্টা নৌকা বেয়ে তারপরে বাড়িতে নিয়ে গেছে মায়ের লাশ। বাবার কবরের পাশে তার লাশ দাফন করেছে।
সেই ভদ্রলোকের ছেলে স্কুলে গিয়েছিল। সে পাশের বাসায় বলে গিয়েছিল যে, আমার ছেলে স্কুল থেকে এলে তাকে তোমরা একটু দেখো। এখন থেকে ৫০-৬০ বছর আগে তো মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক অনেক ভালো ছিল। ছেলে স্কুল থেকে এসে দেখল যে, মা-বাবা নেই। দাদি মারা গেছে, মা-বাবা লাশ নিয়ে চলে গেছে। সে পাশের বাসায় ছিল এবং সেই ছেলে তার মা-বাবার জন্যে একইরকম করেছে, যেভাবে তার বাবাকে সে দেখেছে তার দাদির জন্যে করতে।
এই ছেলের মা মনে করত যে, ছেলের অনেক টাকা। তাই যখন-তখন ছেলের কাছে টাকা চাইত। আর ছেলেও কোনোদিন মাকে না করত না। অর্থাৎ তার কাছে থাকলে দিত। মা মারা যাওয়ার পরে দেখা গেল, তার বিছানার নিচে এখানে সেখানে সাত-আট লক্ষ টাকা। ছেলে যে এটা জানত না, তা নয়। কিন্তু তারপরও মাকে কখনো না করে নি। কারণ তার তো স্মৃতিতে আছে যে, তার বাবা তার দাদিকে এভাবে নিয়ে গিয়েছিল।
আসলে মা-বাবাকে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। সন্তান তো দেখে শিখে। সে খেয়াল করে আমার বাবা আমার মার সাথে কেমন ব্যবহার করে, আমার মা আমার দাদির সাথে, আমার নানা-নানির সাথে কেমন ব্যবহার করে। কারণ প্রত্যেক সন্তানের কাছে বাবা-মা হচ্ছে রোল মডেল। সে যদি আপনাকে কখনো অন্যায় করতে না দেখে সে খারাপ হতে চাইলেও পারবে না। কারণ তার স্মৃতিতে তো এটা নেই। কিন্তু যখন সে দেখে তা মা-বাবা বলে একরকম আর করে আরেকরকম তখনি সমস্যা হয়।
আরো বেশি সমস্যা হয়, যখন সে পরিবারে আত্মীয়স্বজনের গীবত করতে দেখে। আপনি হয়তো আপনার শাশুড়ির নিন্দা করলেন, সে তো আপনার সন্তানের দাদি, যাকে হয়তো সে অনেক পছন্দ করে। অতএব তখন সে আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলবে।
অতএব ছেলেমেয়ের সামনে কখনো আত্মীয়স্বজনের নিন্দা করবেন না। কারণ তার কাছে এগুলো একেকটা ফিগার। যখনি নিন্দা করছেন, সে একটা দ্বন্দ্বে পড়ে যাচ্ছে মা ঠিক, না অমুকে ঠিক, বাবা ঠিক, না অমুকে ঠিক। অতএব সন্তানের সামনে কখনো কারো নিন্দা করবেন না। এতে আপনার সম্পর্কে তার নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। আর অধিকাংশক্ষেত্রে আমরা গীবত করি খাবার টেবিলে বসে। আমাদের যে এত গ্যাস্ট্রিক আলসার এই খাবার টেবিলে গীবত করার কারণে।
এখন আপনি ছেলেকে কমান্ড সেন্টারে এনে তাকে বোঝান যে, আমি যদি কিছু ভুল করে থাকি সেটা ভুলই ছিল। কিন্তু সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি তুমি করো না। কারণ তাহলে তোমার সন্তানও একই ভুল করবে।
তথ্যসূত্রঃ প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড
Related Posts
Q&A Series – Episode 292: Failure is the pillar of success!
Q&A Series – Episode 291: What exactly is visualization?
Q&A Series – Episode 290: How does visualization work?