ব্যাংক খাতে অর্থ লেনদেন কমেছে। এক্ষেত্রে নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। অতীতে ব্যাংকের কিছু মাধ্যমে লেনদেন কমলেও অন্য মাধ্যমগুলোয় লেনদেন বেড়েছে। কিন্তু এবারই ব্যতিক্রমগেছে। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের ফলে এমনটি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশের ব্যাংক খাতে অর্থ লেনদেনে ছন্দপতন চলছে। যেমন এক বছর আগের তুলনায় এখন ব্যাংকগুলোয় চেকের মাধ্যমে লেনদেন কম হচ্ছে। লেনদেন কমছে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি), ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ডসহ অন্যান্য মাধ্যমেও। তবে এক্ষেত্রে কিছু মাধ্যমে লেনদেন কমলেও অন্য মাধ্যমগুলোয় লেনদেন বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেছে। কিন্তু চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ওই সময় একসঙ্গে দেশের সব ধরনের পেমেন্ট ব্যবস্থায় লেনদেন কমে গেছে। এ ধরনের ঘটনা দেশের ব্যাংক খাতে এর আগে কখনই দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছাড়াও দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী সংকট চলছে। জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে বাজারে পণ্য বিক্রি হ্রাস পেয়েছে। আবার মূল্যস্ফীতির প্রভাবে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে। দেশের আমদানি কমে গেছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি রফতানি প্রবৃদ্ধিও শ্লথ। সংকটের প্রভাবে গ্রাহকরা ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ডলারের বাজারে অস্থিতিশীলতাসহ অর্থনীতির নানামুখী এসব সংকটের প্রভাবে ব্যাংকে লেনদেন কমে গেছে।
দেশের মোট ব্যাংক লেনদেনের প্রায় অর্ধেক এখনো চেক-নির্ভর। চেকের মাধ্যমে লেনদেন কমলে ইএফটির মাধ্যমে লেনদেন বাড়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। এছাড়া লেনদেন কমেছে ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মতো ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থায়ও। কভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে ইন্টারনেট ব্যাংকিং বেশ জনপ্রিয় হয়। তবে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এসে ডিজিটাল মাধ্যমেও ব্যাংকিং লেনদেন কমেছে। এদিকে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থ লেনদেনের প্রধানতম মাধ্যম এখন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও এজেন্ট ব্যাংকিং। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এ দুই মাধ্যমেও চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে লেনদেন কমে গেছে।
চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে গিয়ে উপনীত হয়। দেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতি গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে সব ধরনের পণ্য বিক্রি কমে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পাশাপাশি প্রায় দুই বছর ধরে দেশে ডলার সংকট চলছে। এ সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের আমদানি কমার হার ছিল ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানি কমার হার প্রায় ২৪ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি মাসে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হতো, বর্তমানে তার অর্ধেক আমদানি হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় দেশের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ বসে থাকছে বলেও ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন থেকে জানানো হয়েছে।
এ রকম পরিস্থিতির প্রতিফলন ব্যাংক খাতের ওপর পড়েছে। যে কারণে ব্যাংকে সব ধরনের লেনদেন কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরাও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার প্রভাব ব্যাংক খাতের লেনদেনে ফুটে উঠছে বলে মত দিয়েছেন। বস্তুত জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পেলে ব্যাংকে লেনদেনও বাড়ার কথা। কিন্তু বাজারে সবকিছুর দাম বাড়লেও ব্যাংকে লেনদেন কমে গেছে, যা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। এর মূল কারণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নেই। এছাড়া ডলার সংকটের প্রভাব অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। আমদানি কমার দরুন সংশ্লিষ্ট সব খাতের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শেয়ারবাজার অনেক দিন ধরে স্থবির রয়েছে। ব্যাংকে লেনদেন কমার ক্ষেত্রে এ স্থবিরতারও দায় রয়েছে।
ব্যাংক নির্বাহীদের মতে, অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হওয়ার আগে ব্যাংকে দৈনিক যে পরিমাণ অর্থ লেনদেন হতো, এখন তার চেয়ে অনেক কম অর্থ লেনদেন হচ্ছে। এ কারণে দেশের অনেক ব্যাংকেরই ক্যাশ-ফ্লো বা নগদ প্রবাহ নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে। অর্থাৎ ব্যাংকে যে পরিমাণ অর্থ প্রবেশ করছে, তার চেয়ে বেশি বের হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে দেশের অর্থনীতির কোনো সূচকই স্থিতিশীল নয়। রেমিট্যান্স নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতা চলছে। হুন্ডি-হাওলার দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। প্রণোদনা দেয়ার পরও আনুষ্ঠানিক খাতে রেমিট্যান্স বাড়ছে না। ডলার সংকট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপের কারণে আমদানি এক-চতুর্থাংশ কমে গেছে। রফতানি প্রবৃদ্ধিও ক্রমেই শ্লথ হয়ে এসেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বিপরীতে পণ্য বিক্রির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। বিশেষ করে এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প) প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি বেশ খারাপ। এসব সংকটেরই বহিঃপ্রকাশ দেশের ব্যাংক খাতে লেনদেন কমে যাওয়া। আমরা প্রত্যাশা করব ব্যাংক খাত দ্রুত সংকট কাটিয়ে যাবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য নীতি সুদহার বাড়ানোসহ যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তার ফল পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী। চলমান সংকট অতিক্রম করে ব্যাংক খাতে লেনদেন স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসবে, এটিই সবার কাম্য।