বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) সংশোধন, পরিবর্তন ও প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আইনটি প্রতিস্থাপিত হবে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩’ নামে। গতকাল আইনটির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নতুন আইন কার্যকরের পর বিদ্যমান ডিএসএ রহিত হয়ে যাবে।
মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি ২০১৮ সালে করা হয়েছিল। এই পাঁচ বছরে আইনের আলোকে আমাদের কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সারা বিশ্বে আইসিটি সংক্রান্ত যে অবয়ব ছিল, সেটিও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আইসিটি সংক্রান্ত অপরাধের ব্যাপ্তি ও ধারার পরিবর্তন হয়েছে। সমস্ত বিষয় বিবেচনায় রেখে “সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩” প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইন কার্যকর করার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যমান ডিএসএ রহিত হয়ে যাবে।’
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘নতুন আইনে সার্বিক বিষয়টি দেখভালের জন্য একটি এজেন্সি থাকবে। এজেন্সির নাম হবে “জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি’’। সাইবার সংক্রান্ত কিছু অপরাধকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এসব অপরাধের শাস্তির বিধান বা মাত্রা ঠিক করে দেয়া হয়েছে। বিদ্যমান ডিএসএর জন্য “ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি’’ রয়েছে। নতুন আইন কার্যকর হলে নাম পরিবর্তন হয়ে সেটি “জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি” নামে অভিহিত হবে। তাদের ক্ষমতা বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে।’
নতুন আইনে ডিএসএর ১২টি ধারা সংশোধন করে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। ধারাগুলো হলো ১৮, ২০, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৬। এর মধ্যে ১৮ ধারায় অপরাধের বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে বা প্রবেশ করতে সহায়তা করে, তাহলে ১৮ ধারার ২ উপধারা অনুযায়ী, ওই ব্যক্তির ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকার জরিমানা হবে। একই অপরাধ পুনরায় করলে মূল অপরাধের জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত রয়েছে তার দ্বিগুণ দণ্ড হবে।
ডিএসএর ২০ ধারায় কম্পিউটারের সোর্স কোড পরিবর্তন, ২২ ধারায় ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিকস জালিয়াতি, ২৩ ধারায় ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিকস প্রতারণা, ২৪ ধারায় পরিচয় প্রতারণা ও ছদ্মবেশ ধারণ, ২৫ ধারায় আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য উপাত্ত প্রেরণ প্রকাশ, ২৬ ধারায় অনুমতি ব্যতীত পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহার, ২৭ ধারায় সাইবার সন্ত্রাসী কার্য সংগঠন, ২৮ ধারায় ওয়েবসাইট ও কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন তথ্য প্রকাশ ও সম্প্রচার, ২৯ ধারায় মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচার, ৩১ ধারায় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধ ও দণ্ডের বিধান রয়েছে।
ডিএসএর এসব ধারায় সংঘটিত অপরাধ জামিন অযোগ্য। নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে এসব অপরাধ হবে জামিনযোগ্য। তবে এসব অপরাধের জন্য ডিএসএতে যে অর্থদণ্ড ছিল সাইবার নিরাপত্তা আইনে তা বাড়ানো হয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘বিদ্যমান ডিএসএর যে কাঠামো রয়েছে, সেখানে অজামিনযোগ্য বিধানগুলো বেশি ছিল। এখানে সেই বিষয়গুলোর বেশির ভাগই জামিনযোগ্য করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এখানে সাজার ক্ষেত্রে বিদ্যমান যে আইন রয়েছে, সেখানে জেলের ওপর ফোকাসটা বেশি ছিল, এখানে এসে সাজার পরিমাণ কমানো হয়েছে কিন্তু আর্থিক জরিমানা কিছু কিছু ধারায় বেশি করা হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বড় পরিবর্তন হলো ডিএসএর অনেক উপধারায় একই অপরাধ দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার করলে সাজার মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ে। নতুন আইনে সেটি বাদ দেয়া হয়েছে।’
অন্যদিকে অনুমোদিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে ছয়টি ধারায় শাস্তি কমানো হলেও অপরাধগুলো জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। ধারাগুলো হলো ডিএসএর ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩। এর মধ্যে ডিএসএর ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে বেআইনি প্রবেশ, বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে ক্ষতিসাধন করেন তাহলে ওই ব্যক্তির সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ২৫ লাখ টাকার জরিমানা হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে বা বারবার করলে ১ থেকে ৫ কোটি টাকা জরিমানা ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাত বছর কারাদণ্ডের স্থলে তিন বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
ডিএসএর ১৯ ধারায় কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেমের ক্ষতিসাধন, ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা, ২৭ ধারায় সাইবার সন্ত্রাসী কার্য সংগঠন, ৩০ ধারায় আইনানুগ কর্তৃত্ববহির্ভূত ই-ট্রানজেকশন, ৩৩ ধারায় বেআইনিভাবে তথ্য উপাত্ত ধারণ ও স্থানান্তরের অপরাধ রয়েছে। এসব ধারায় কোনো ব্যক্তি অপরাধ সংঘটিত করলে তার আর্থিক দণ্ডের পাশাপাশি মামলা অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। তবে দণ্ড কমানো হয়েছে।
বিদ্যমান ডিএসএ অপব্যবহার হচ্ছে এমন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে নতুন আইন করা হচ্ছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘সরকার একটি আইন করেছে বাস্তবতার নিরিখে। এটি অপব্যবহার হচ্ছে তা আপনার কীভাবে বলতে পারেন? একটা আইন করা হয়েছে, তা প্রয়োগ করা হয়েছে। দেশ ও আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ায় যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, সেখানে সরকার মনে করেছে সাইবার সিকিউরিটির জন্য একটা আইন দরকার, সেজন্য আগের আইন থেকে কিছু ধারা ও বিষয় এখানে সংশোধিত করা হয়েছে।’
বিদ্যমান ডিএসএতে ৬০টি ধারা রয়েছে। নতুন আইনে কতগুলো ধারা থাকবে এমন প্রশ্নে মাহবুব হোসেন বলেন, ‘পুরো কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
Related Posts
The Journey of Political Rights and Civil Liberties in Bangladesh
Bangladesh’s Deadliest Natural Disasters: A Grim Chronicle of Nature’s Fury
Bangladesh’s Rising Military Power: A 2024 Snapshot