আজ ১৬ ডিসেম্বর, আমাদের সবচেয়ে গৌরবময় অর্জনের দিন। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এ দিন বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। মর্যাদাপূর্ণ এ দিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় নেতা, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তার দূরদর্শী আহ্বানে সর্বস্তরের বাঙালি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী ৩০ লাখ শহীদকে এবং সম্ভ্রম হারানো দেশমাতৃকার বীর নারীদের। আরো স্মরণ করছি স্বাধীনতা যুদ্ধে নিবেদিত ভূমিকা রাখা জাতীয় চার নেতাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতা করা বিভিন্ন রাষ্ট্র ও ব্যক্তির প্রতিও আমাদের অপরিসীম কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
মূলত অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা আর সীমাহীন বৈষম্যের প্রতিকারেই বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়। ১৯৭১ সালের এ দিনে বিজয় লাভের পর বাংলাদেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমাগত অর্থনৈতিক উন্নয়নের বদৌলতে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ এখন ইমার্জিং টাইগার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। তবে বাংলাদেশ যেমন অর্জন করেছে, ঠিক তেমনি আমাদের অনেক ঘাটতিও রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আমাদের দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে গেছে, যা ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে পারেনি। পোশাক শিল্প রফতানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও এ খাতে নতুন বাজার সন্ধানে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। কিন্তু প্রবাসে দক্ষ জনশক্তি রফতানির চেয়ে শুধু কর্মী প্রেরণেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। যে কারণে দেশে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে রেমিট্যান্স আসছে না। সেই সঙ্গে প্রবাসীদের বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোতে উৎসাহিত করার দৃশ্যমান তৎপরতা চোখে পড়ছে না। দেশের ব্যাংক খাতে সংকট বিরাজ করছে। ব্যাংকের সব মাধ্যমেই লেনদেন কমেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ ভালো নেই। উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ বেশ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না।
এদিকে অবকাঠামো খাতে কয়েক দশকে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে গত বছর উদ্বোধন হয়েছে বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর। যার ফলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছে। চলতি বছরই বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধন হয়েছে। গত বছর চালু হওয়া দেশের প্রথম মেট্রোরেল এখন ঢাকাবাসীর আস্থার পরিবহনে পরিণত হচ্ছে। বাকি স্টেশনগুলো চালু হলে এর প্রকৃত সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ দেশের সড়ক খাতে নানা উন্নতির ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও সড়কপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনো সম্ভব হয়নি। যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না।
ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির ফলে দেশের বাজেটের আকার বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি জিডিপি বেড়েছে। তবে করোনা মহামারী অতিক্রম করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশেও এসে পড়েছে। আমাদের প্রবাসে শ্রমশক্তি রফতানির বাজার সংকুচিত হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে দৃশ্যমান কর্মতৎপরতাও লক্ষণীয় নয়। দেশে বেকারত্বের হার ক্রমে বাড়ছে। এদিকে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। হরতাল-অবরোধে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। অবস্থার পরিবর্তন না হলে উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে বিধিনিষেধ আরোপের ঝুঁকিতে আছে দেশ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন ক্রান্তিকালের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ সময়ে গৃহীত সুচিন্তিত পদক্ষেপের ফলে আমরা আগামী বছর সব সংকটের ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে পারব সে আশা করা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে খুবই সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও শ্রীলংকার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তারা সংকটকালীন সময়ে সঠিক পথে না থাকায় তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। যদিও শ্রীলংকা সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, এক্ষেত্রে শ্রীলংকার কাছ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয় অনেক কিছুই রয়েছে।
বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তির পথে অনেকাংশে অগ্রসর হয়েছে। ই-টেন্ডার থেকে শুরু করে নাগরিকদের সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বর্তমানে ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পেলেও তথ্যের নিরাপত্তায় ঘাটতি ঠিকই রয়ে গেছে। এ বছর হ্যাকারদের আক্রমণের ফলে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের মতো ঘটনা ঘটেছে। দেশের নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অনুষঙ্গ জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তি ও তথ্য সংশোধনে নাগরিকরা এখনো ভুক্তভোগী হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান বাড়লেও উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া লক্ষ করা যায় না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশন জট কমলেও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে শুধু সনদধারীর সংখ্যাই বাড়ছে, উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের শিক্ষাজীবনে অধ্যয়ন করা বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পরিবর্তন হয়নি। যৌন হয়রানিসহ নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে।
করোনা মহামারীর ঢেউ বাংলাদেশ সতর্কতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারলেও চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে দৃশ্যমান অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার ঘটলেও এক্ষেত্রে কার্যত সমাধানে উদ্যোগ স্বস্তিকর নয়। রাজধানী ঢাকা শহর এখন বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার এত বছর পরও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হয়নি। শহরের নদী-নালা, খাল-বিলগুলো দূষিত হয়ে যাচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের নিম্নবিত্ত মানুষ খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছে। মধ্যবিত্তদের আর্থিক অবস্থাও করুণ হচ্ছে। বিজয় দিবস উদযাপনের এ পাদপ্রদীপের আলোর নিচে, আলোকবাতি সাজানো ভবনের পাশেই রাস্তায় ঘুমানো মানুষ পাওয়া যাবে। তাদের ক্ষুধা ও আশ্রয়ের কথা রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। যে অর্থনৈতিক বঞ্চনা প্রতিকারে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো বাংলাদেশ দেখেনি। যে কৃষকের উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে আমাদের পেটে অন্ন আসে, দেশের শিল্প-কারখানা সচল থাকে, সেই কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। উচ্চ দামে কৃষিপণ্য বিক্রি হলেও বড় অংকের লাভ মধ্যস্বত্বভোগীরা পাচ্ছে। চলতি বছরও আমাদের জ্বালানির সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে। আমাদের গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন। এছাড়া সংকট সমাধানে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে জোর দিতে হবে। আমরা অবশ্যই বিজয় উল্লাস করব, কিন্তু বৈশ্বিক নানা সংকটের এ সময়টিতে দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির কোনো বিকল্প নেই। আমরা আশা করব, এ কঠিন সময়ে বাংলাদেশ অবশ্যই সঠিক পথেই থাকবে, তাহলেই পূরণ হবে আমাদের বিজয়ের স্বপ্ন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কফির দাম ফুলেফেঁপে উঠেছে। ব্রাজিল, ভারত, ভিয়েতনামের মতো প্রধান কফি উৎপাদনকারী দেশে প্রতিকূল আবহাওয়া ও সরবরাহ সংকটের কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যদিও গ্রাহকরা এক কাপ কফি পান করতে বেশি পয়সা খরচ করছেন কিন্তু কফি চাষীরা তা থেকে সামান্যই লাভ পাচ্ছেন। দরকষাকষির পর্যাপ্ত ক্ষমতা না থাকার কারণে বর্ধিত দামের সুবিধা ঘরে তুলতে পারছেন না কফি চাষীরা।
১৯৫০-এর দশক থেকে শুরু করে এখনো বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত পণ্যগুলোর মধ্যে আছে কফি। একসময় তেলের পর পরই সবচেয়ে বিক্রীত পণ্য ছিল এ পানীয়। অনেক দেশের সরকার তো কফিকে কৌশলগত পণ্য হিসেবেও বিবেচনা করে। এদিক থেকে এগিয়ে থাকার ক্ষেত্রে কফিকে অন্যতম পণ্য হিসেবে বিবেচনা করেন কিন্তু সব কফি ব্যবসা সমানতালে একইভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো অপেক্ষাকৃত কম মানসম্পন্ন অপ্রক্রিয়াজাত কফি, কাঁচা মটরশুঁটি এবং শুকনো বীজহীন কফি রফতানি করে—যেখানে ব্রাজিল, কলাম্বিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ইথিওপিয়া সম্মিলিত কফি বাজারের শেয়ারের প্রায় ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। আবার গ্লোবাল নর্থের দেশগুলো ভালো মানের প্রক্রিয়াজাত কফি, যেমন রোস্টেড বিন এবং ‘ইনস্ট্যান্ট’ কফির রফতানিতে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। এক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলোর নাম চলে আসে; যারা বাজারের ৭০ শতাংশ রফতানি নিজেদের দখলে রেখেছে৷। অধিকন্তু কফি সেক্টরে মাত্র তিনটি উন্নত দেশের সংস্থার আধিপত্য রয়েছে—নেসলে, স্টারবাকস ও জেডিই পিট। এই তিনটি কোম্পানিই মূলত কফি সেক্টরের দশটি বৃহত্তম সংস্থার সম্মিলিত রাজস্বের ৭৭.৭ শতাংশ একত্র করতে সক্ষম!
প্রক্রিয়াজাত কফির দাম অপ্রক্রিয়াজাত কফির তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য বলা চলে (গড়ে প্রতি কেজি ১৪.৩০ ডলার বনাম ২.৪০ ডলার)। প্রকৃতপক্ষে গ্লোবাল সাউথের কফি উৎপাদনকারীরা বাজারের মূল্যের একটি ছোট এবং ক্রমহ্রাসমান অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। যেখানে ১৯৯২ সালে কফি উৎপাদক দেশগুলো কফি রফতানি করে বাজারমূল্যের এক-তৃতীয়াংশ দখল করেছিল; ২০০২ সালের মধ্যে তারাই ১০ শতাংশেরও কম বাজারমূল্যের রফতানীকৃত কফি তাদের দখলে আনতে পেরেছিল। কফি চাষীরা নিজেরাই এক কাপ কফির জন্য চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ১ শতাংশ বা আরো কম পেয়ে থাকেন। তারা গ্লোবাল নর্থের ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করা কফি প্যাকেজের জন্য ধার্য করা মূল্যের প্রায় ৬ শতাংশ পান।
গ্লোবাল সাউথের কফি উৎপাদকদের জন্য সুস্পষ্ট সমাধান হবে—তাদের রফতানি মূল্য সংযোজন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো। কিন্তু এ ধারায় অগ্রগতি অব্যাহত রাখার পথে প্রবল বাধা রয়েছে! উন্নত দেশগুলো প্রক্রিয়াজাত কফি আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৭.৫-৯ শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০-১৫ শতাংশ এবং জাপানে ২০ শতাংশ করে শুল্ক আরোপ করে থাকে। এক্ষেত্রে আবার প্রক্রিয়াবিহীন বা অপ্রক্রিয়াজাত কফিতে শুল্ক ধার্য করা হয় না।
অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলো শুল্ক আরোপ করার সময় প্রক্রিয়াকৃত এবং অপ্রক্রিয়াজাত কফির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে চায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্রাজিলে উভয় ধরনের কফির আমদানিই ১০ শতাংশ শুল্কসাপেক্ষে বিবেচ্য। সুতরাং যখন উন্নত দেশের নেতৃত্বাধীন বহুপক্ষীয় ব্যাংক এবং গবেষণা সংস্থাগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের রফতানি মূল্য সংযোজন করার পরামর্শ দিচ্ছে, তখন উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্য নীতি তাদের তা করতে নিরুৎসাহিত করছে।
প্রতিহত করার জন্য আর্থিক প্রণোদনার ওপর নির্ভর করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, তারা প্রক্রিয়াকৃত কফি রফতানিতে ভর্তুকি দিতে পারে এবং প্রক্রিয়াবিহীন কফির ওপর রফতানি শুল্ক আরোপ করতে পারে। মালয়েশিয়া পাম তেলের বিষয়ে অনুরূপ পদক্ষেপ নিয়েছিল: যুক্তরাজ্য প্রক্রিয়াজাত পাম তেল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করার পরে মালয়েশিয়া প্রক্রিয়াজাত পাম তেলের ওপর কর কমিয়েছে এবং অপরিশোধিত পাম তেল রফতানিতে রফতানি কর চালু করেছে।
গ্লোবাল সাউথের প্রক্রিয়াকৃত কফির সম্ভাব্য রফতানিকারকরাও অশুল্ক বা প্রযুক্তিগত বাধার সম্মুখীন হবেন, যেমন স্যানিটারি এবং ফাইটোস্যানিটারি নিয়মগুলো এ আওতায় পড়ে। এ বিষয়গুলো অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে ন্যায়সংগত, তবে তা কাটিয়ে উঠতে এ দক্ষিণ ভাগের রফতানিকারকদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরিতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এছাড়া রোপণ ও প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির বিকাশের স্বার্থেও এ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, পরিবেশগত ও সামাজিক মান পূরণ করার বিষয়াদি মাথায় রেখে বিনিয়োগ করার কথা ভাবতে হবে।
গ্লোবাল সাউথের রফতানিকারকরা চাইলে উত্তরের ভোক্তাদের কাছে উৎপাদিত ব্র্যান্ডেড কফি সরাসরি বিক্রি ও রফতানি করতে পারে। সর্বোপরি, ব্র্যান্ডিং ও বিপণন হলো সর্বোচ্চ মূল্য সংযোজন করার মতো একটা জায়গা৷যেখানে সমস্যা তৈরি হয় যখন বাজারে ভোক্তা প্রবেশের বাধাগুলো খুব তীব্র হয়, তখন একটি নতুন ব্র্যান্ড তৈরি করতে যথেষ্ট সম্পদ এবং ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতা থাকতে হয়।
একমুখী সংস্থাগুলো ওই বাধাগুলোর মধ্যে কয়েকটিকে অতিক্রম করতে পারে, যা বিদ্যমান ব্র্যান্ডগুলোকে দখলে নেয়ার পদক্ষেপ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ার ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া যায়—তারা লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে বিদ্যমান ব্রিটিশ পাম অয়েল সংস্থাগুলোর প্রতিকূল বা বিপজ্জনক হস্তান্তর ঘটিয়েছে; অর্থাৎ সংস্থাগুলোকে ঝুঁকি নিয়ে হলেও নিজেদের আওতায় এনেছে৷। প্রকৃতপক্ষে কেবল চায়নাই নয়, বরং এ ধরনের আন্তর্জাতিক অধিগ্রহণ বাজারের অন্যান্য ‘লেট কামার’ দেশগুলোর জন্য একটি প্রয়োজনীয় কৌশল হিসেবে কাজ করে থাকে।
গ্লোবাল সাউথের উৎপাদকদের কাছে আরেকটি বিকল্প উপায় রয়েছে: তারা একটি ওপেক স্টাইলের কফি ‘কার্টেল’ তৈরি করতে পারে, যা গ্লোবাল নর্থের তুলনায় দাম ও শুল্কের বিষয়ে অনেক বেশি দরকষাকষির ক্ষমতা রাখতে পারবে। এ পদ্ধতি রেডিক্যাল মনে হলেও বাস্তবসম্মত বলা চলে, কারণ গ্লোবাল সাউথের শীর্ষ দশ কফি উৎপাদনকারীরা বাজারের প্রায় ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। আবার পদ্ধতিটি ন্যায়সংগতও হবে, কারণ তখন কার্টেলটি যে সাপ্লাই-সাইড’ অলিগোপলির প্রতিনিধিত্ব করবে তা বিদ্যমান ‘ডিমান্ড-সাইড বা রোস্টার’ অলিগোপলিকে মোকাবেলার উদ্দেশ্যেই বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হবে।
প্রথমত, গ্লোবাল সাউথের কফি সেক্টরকে একত্র করতে হবে, যেখানে ছোট সংস্থাগুলোকে একীভূতকরণ এবং অধিগ্রহণের মাধ্যমে এক ছাদের নিচে আনা সম্ভব হবে। নতুন বড় কোম্পানিগুলো সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে রফতানি করা কফির মান উন্নত এবং পরিবর্তন করতে সহায়তা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ‘ফেডারেশন ন্যাসিওনাল ডি ক্যাফেটেরোস ডি কলম্বিয়া নামক সংস্থা কলম্বিয়ান ফ্রিজ-ড্রাই কফি উৎপাদক’ বুয়েনক্যাফের সঙ্গে কাজ করতে পারে। এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ান পাম অয়েল বোর্ড মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে।
বিশ্বব্যাপী কফি বাজারের অসামঞ্জস্যগুলো অবশ্যই বহুপক্ষীয় ফোরাম যেমন জাতিসংঘ বা জি২০-তে সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু যতদিন উন্নত দেশগুলো সক্রিয়ভাবে তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর কফি থেকে অর্থোপার্জনের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে চলবে, ততদিন গ্লোবাল সাউথের উৎপাদকদের নিজের হাতে বিষয়গুলো তুলে নেয়া ছাড়া উন্নয়নের আর বিকল্প কোনো পথ থাকবে না। শুল্ক, ভর্তুকি, বিপজ্জনক টেকওভার, এমনকি একটি কফি কার্টেল গঠন করার আলোচনা আলাপচারিতায় তুলে আনা প্রয়োজন।
কিয়ুন লি: দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের জাতীয় অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এবং ইন্টারন্যাশনাল শুম্পেটার সোসাইটির সাবেক প্রেসিডেন্ট, সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক, ২০১৪ শুম্পেটার পুরস্কার বিজয়ী এবং ‘চীনের টেকনোলজিক্যাল লিপফ্রগিং অ্যান্ড ইকোনমিক ক্যাচ-আপ: এ শুম্পেটেরিয়ান পারস্পেকটিভ’-এর লেখক।
Related Posts
Global Debt Crisis: Nations on the Brink of Default
Bangladesh’s Hidden Wealth: A Journey Through Its Natural Treasures
Global Unemployment Rankings: A Closer Look at Economic Health