Business Care News

Business News That Matters

BusinessCare.news, Editorial Banner

বিদেশি বিনিয়োগ আসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের ফিরিয়ে আনতে কার্যকারী উদ্যোগ গ্রহণ করা খুবই জরুরী

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা  যায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৩২৪ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার। আগের অর্থবছরে যা ছিল ৩৪৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এ হিসেবে নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ইকুইটি ক্যাপিটাল প্রবাহ ছিল ১৩৪ কোটি ৬৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ইকুইটি ক্যাপিটাল প্রবাহ দাঁড়ায় ৭৯ কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার ডলারে। এ হিসেবে নতুন বিদেশী মূলধনি বিনিয়োগ কমেছে ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ। ২০২১ সালের জুন শেষে দেশে ইকুইটি ক্যাপিটাল স্টকের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৭০ কোটি ২৫ লাখ ১০ হাজার ডলার। ওই বছরের ডিসেম্বর শেষে যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৬০ কোটি ১০ লাখ ৯০ হাজার ডলারে। ২০২২ সালের জুন শেষে ইকুইটি ক্যাপিটাল স্টকের পরিমাণ হয় ১ হাজার ৩৯৩ কোটি ৭৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার। চলতি বছরের জুন শেষে যার পরিমাণ হয়েছে ১ হাজার ৩২৭ কোটি ৭৮ লাখ ২০ হাজার ডলার। এ হিসাবে এক বছরে ইকুইটি ক্যাপিটাল স্টক কমেছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের উপাত্তে স্পষ্ট, দেশে নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে যে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো এখনো কোনো কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক রূপান্তরে সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই)। আশির দশক-পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম, চীন, মেক্সিকো ও ভারতের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে অবদান রেখেছে এফডিআই। বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে এফডিআই।

অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে নতুন নতুন খাত সৃষ্টি জরুরি। নতুন খাত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে বিদেশী বিনিয়োগ। তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের প্রধান রফতানিমুখী খাত হিসেবে দাঁড়ানোর পেছনেও বৈদেশিক বিনিয়োগের ভূমিকা রয়েছে। কোনো দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসা মানে হচ্ছে, তাদের উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ আছে এবং সেখানে ব্যবসা লাভজনক। করোনা মহামারীর সময়েও বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহ চমৎকার ছিল। এখন কেন কমছে তা অবশ্যই চিন্তার ব্যাপার। 

গত বছর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপীই এফডিআই প্রবাহ ও ইকুইটি ক্যাপিটাল স্টক নিম্নমুখী ছিল। কিন্তু চলতি বছরে অনেক উন্নয়নশীল দেশই বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছে। আমাদের এখানে না আসার বড় কারণই অভ্যন্তরীণ। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেকেই এ দেশে বিনিয়োগ করতে চায় না। বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চাইলে আমাদেরকে এ সমস্যাগুলো সমাধা করতে হবে। গত কয়েক মাসে তিনটি শীর্ষ ঋণমান সংস্থার সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান কমেছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের পথে যা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। 

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের আর্থসামাজিক, অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বৈদেশিক বিনিয়োগ। অর্থনীতির সূত্র হলো, দেশী বিনিয়োগ বাড়লে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ে। কারণ দেশী বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে বিদেশী বিনিয়োগ আসে। সে কারণে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে তারল্য সংকট দূর করতে হবে। ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ এবং ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। এ অবস্থায় অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সব সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে। 

বাংলাদেশের বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বৃদ্ধির উপায় হলো দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা হ্রাস। বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রধান উপাদান হলো সস্তা শ্রম। কিন্তু এখন শুধু সস্তা শ্রম দিয়ে খুব বেশি বিনিয়োগ আনা যাবে না। সেজন্য তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরিতে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে। একই সঙ্গে শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি, উন্নত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। সেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে যেসব শিল্প বৃহৎ পুঁজি আকর্ষণ করে। বৃহৎ পুঁজি ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানেই অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। আমাদের মতো জনবহুল দেশে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে ছিল ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মালয়েশিয়ায় প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ১৯৯১-৯৯ সাল পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় মালয়েশিয়ার ইলেকট্রনিকস শিল্পের মোট বিনিয়োগের ৮০ শতাংশের বেশি ছিল বৈদেশিক বিনিয়োগ। ১৯৮০ সালে জাপানের বিনিয়োগের ফলে মালয়েশিয়ার শিল্প খাত বিকাশ লাভ করে এবং দেশটির লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে আত্মনির্ভরশীল শিল্পোন্নত দেশ হওয়া। মালয়েশিয়ায় ‘প্রোটন’ ও ‘পেরোডুয়া’ নামক গাড়ি উৎপাদন হচ্ছে এবং এ শিল্পে প্রায় সাত লাখ লোক কর্মরত রয়েছে। দেশীয় ও বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগে অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। ১৯৯০-৯৭ সাল পর্যন্ত দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৯ শতাংশ। এটি সম্ভব হয়েছে মূলত বৈদেশিক বিনিয়োগের কারণে। ২০২০ সালে মালয়েশিয়ার মোট রফতানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা এবং এর প্রায় ৩৭ শতাংশ ছিল ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস দ্রব্য বিক্রির মাধ্যমে। দক্ষ জনবল, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, তুলনামূলক স্বল্প মজুরি ব্যয়, উন্নত জীবনযাত্রার মান, ডিজিটাল সংযোগ ব্যবস্থা, সরকারের বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতি ইত্যাদি মালয়েশিয়ায় বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও উন্নয়নে সহায়তা করেছে।

থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো যদি বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়, তবে নিঃসন্দেহে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার আরো উন্নতি ঘটবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করার জন্য দেশের ভাবমূর্তি একটি বড় বিষয়। সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, প্রশস্ত রাস্তা, বিদেশী নাগরিকদের সঙ্গে ব্যবহার ও আচরণ, রাজনৈতিক পরিবেশ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যোগাযোগ এবং সংযোগ (কানেক্টিভিটি) ঘটানো ও রক্ষার ক্ষমতা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সম্পদের প্রাচুর্য, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত অথবা প্রশিক্ষণযোগ্য জনবল, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস ইত্যাদি বৈদেশিক বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের কোনো দেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ইমপ্রেশন তৈরি করে, যা বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। 

আধুনিক বিশ্বে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপিতে বৈদেশিক বিনিয়োগের অবদান ১ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের এফডিআই যদি ৫-৬ শতাংশে উন্নীত করা যায়, তাহলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ১০ শতাংশ। সুযোগও রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধ এবং হংকংয়ের ওপর চীনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের কারণে এশিয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্র হংকং থেকে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন। অনেক বৈশ্বিক কোম্পানি তাদের প্রধান কার্যালয় সিঙ্গাপুরে সরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু সিঙ্গাপুরের রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। তাই সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা হয়ে উঠেছে। দফায় দফায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ আগ্রহের কথাও জানিয়েছে সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সিঙ্গাপুর বিজনেস ফেডারেশন (এসবিএফ) সম্প্রতি বাংলাদেশে পোশাক ও ওষুধ খাতে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিডার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত চার বছরে বাংলাদেশে সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগ ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। চীন ও জাপানের বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহ দেখিয়েছে। ইউরোপ থেকেও অনেকে আসতে চাইছেন। পাশাপাশি এটিও সত্যি, বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছু শঙ্কাও কাজ করছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, তার অন্যতম ছিল দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। পাশাপাশি ট্যাক্স, শুল্ক ছাড় এবং মুনাফার প্রত্যাবাসন অন্যতম। দুঃখজনক হলেও সত্য, এক্ষেত্রে অগ্রগতি খুব সামান্যই। এছাড়া দক্ষ জনশক্তির অভাব, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও জমির দুষ্প্রাপ্যতাকেও প্রতিবন্ধকতা মনে করা হয়। এদিকে সরকারের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

Skip to content