অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতিশীলতা রক্ষায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সম্প্রসারণে রিজার্ভ সংকট দূর করা প্রয়োজন। এদিকে বিদ্যমান আর্থিক সংকটে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ নিম্ন পর্যায়ে থাকার আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক। ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর জুড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।
সংস্থাটির আশঙ্কা, চলতি অর্থবছরেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে যেতে পারে নিম্ন পর্যায়ে। সেক্ষেত্রে সরকারকেও আমদানি নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে হতে পারে। চাপ থাকবে মূল্যস্ফীতিরও। এর ধারাবাহিকতায় বাধাগ্রস্ত হবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। সব মিলিয়ে এ অর্থবছরেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি, রপ্তানি ও বেসরকারি বিনিয়োগের মতো সূচকগুলোয় উন্নতির সম্ভাবনা খুব কম। পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও হ্রাস পেতে পারে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ বা ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা’ শীর্ষক ষাণ্মাসিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক এ তথ্য দিয়েছে। এতে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের সম্ভাব্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি, রফতানি এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিশ্বব্যাংকের ভাষ্যমতে, বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ নিম্নমুখী থাকায় আমদানি নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকবে এবং সে কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মূলত রিজার্ভ সংকটে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য চাপের মধ্যে থাকায় আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক।
রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতির স্থিতিস্থাপকতা বজায় থাকা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে। আবার সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) পরিস্থিতিও হুমকির মুখে পড়তে পারে। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপের কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ থেকে তাদের মুনাফা ফেরত নিতে বাধার মুখে পড়ছে। ফলে কয়েক বছর ধরে এফডিআইয়ের যে নিম্ন মাত্রা ছিল তা আরো সংকুচিত হয়ে এসেছে।
এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের হালচাল কেমন তা বোঝার অন্যতম উপায় হলো মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি, আমদানি-রফতানি ও বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বা প্রবৃদ্ধি কেমন তার ওপর। এসব ক্ষেত্রে নতুন বছরে এখনো কোনো ইতিবাচক সূচক লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিশ্লেষকদের ভাষ্যমতে, ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়ার কারণেও বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে ডলার সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা—এসব কারণে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাসে বেসরকারি বিনিয়োগ কমার প্রভাব আছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এদিকে বিশ্বব্যাংকের ভাষ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শ্লথ থাকবে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার ও ব্যবসায়ীদের কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন।
বিনিয়োগের যথাযথ পরিবেশ না পেয়ে বিদেশী বিনিয়োগগুলো অন্য দেশে চলে যায়, অতীতে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এজন্য বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট এড়াতে প্রবাসীরা যেন আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উদ্বুদ্ধ হন সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানিখাতেও পণ্যের বৈচিত্র্যায়ণ ঘটানো প্রয়োজন। শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া পণ্য আমদানি-রফতানিতে ‘ওভার ইনভয়েসিং’ ও ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ এ রকম ‘মিস ইনভয়েসিং’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বড় অংকের অর্থ পাচারের তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায়ও। এভাবে অর্থ পাচার বন্ধ করতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তৎপরতা আরো বাড়াতে হবে।
বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য বিদেশে থাকা দূতাবাসগুলোরও ভূমিকা রয়েছে। প্রবাসীদের কাছ থেকে মাঠ পর্যায়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসকে (এমএফএস) ঢেলে সাজাতে হবে। দেশের বিনিয়োগ খাতের এ রকম দুরবস্থা এড়াতে রিজার্ভ সংকট উত্তরণের বিকল্প নেই। এজন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এফডিআই আকর্ষণে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সময়োপযোগী পদক্ষেপ কাম্য। আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার রিজার্ভ সংকট দূর করতে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। তাহলে রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে আশা করা যায়।