প্রশ্নঃ মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমাদের কীভাবে দেখা উচিত? এই জাতীয় ব্যবসায় জড়ানোর বিষয়ে আপনার মতামত কী?
উত্তরঃ আসলে মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দরিদ্ররা কতখানি উপকৃত হচ্ছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। মাইক্রোক্রেডিট ব্যবস্থার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট অনেকেই পরবর্তীতে এই ধারণায় পৌঁছেছেন যে, ঋণশোধের জন্যে গ্রহীতাদের যে শারীরিক মানসিক ও পারিবারিক ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয় তার তুলনায় এর আর্থিক সুফল নেহায়েতই নগণ্য।
৩১ জুলাই ২০০৭-এ দৈনিক ভোরের ডাকের খবর : ‘৩১৯ টাকার জন্যে একমাস ধরে জেলে’। এতে বলা হচ্ছে—‘যে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে এখনো অনেক নেতা-আমলা বুক ফুলিয়ে কথা বলে, দম্ভভরে চলাফেরা করে সে দেশে মাত্র ৩১৯ টাকা ঋণশোধ করতে না পারায় একজন গরিব কৃষক জেল খাটছেন একমাস ধরে। ভাবতে কষ্ট হয়। চকোরিয়া উপজেলায় এ ঘটনা ঘটেছে। গরিব কৃষক আজম খান। কোস্ট ট্রাস্ট নামে একটি এনজিও-র মাত্র ৩১৯ টাকা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে একটি মামলায় গ্রেফতার হন। একই সংস্থার ২,৩০৫ টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে জেল খাটছেন আরেক কৃষক বেলাল উদ্দীন। বর্তমানে ঋণভয়ে অনেকে গ্রামছাড়া।’
প্রথম আলোর একটা খবরের শিরোনাম—‘রাজশাহীতে নিম্নবিত্তের বিবাহবিচ্ছেদের পেছনে আছে ক্ষুদ্রঋণ।’ এতে বলা হচ্ছে, রাজশাহীতে দুটো কারণে বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে। একটি স্বামীর মাদকাসক্তি, এটা সমাজের সব অংশের জন্যে প্রযোজ্য। দ্বিতীয়টি ক্ষুদ্রঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারা। এটা শুধু নিম্নবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে ঘটছে। মেয়েরা যেহেতু ঋণ পায়, স্বামীরা স্ত্রীকে দিয়ে ঋণ নেওয়ায় এবং খরচ করে। এরপর সেই স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে নতুন স্ত্রী গ্রহণ করে।
আসলে জামানত ছাড়া যে ঋণ দেয়া হয় তা উদ্ধার করা হয় কীভাবে? পটুয়াখালীর এক সদস্য ঋণের কিস্তি দিতে পারে নি বলে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীরা তার পা ভেঙে দিয়েছে। সিঙ্গাইরে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীরা টাকা না পেয়ে কারো গরু নিয়ে গেছে, কারো নোলক নিয়ে গেছে। রংপুরে কিস্তির টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে এক সদস্য আত্মহত্যা করেছে। ঋণ নিয়ে এদের অবস্থা হচ্ছে, কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়া জমিদারের জমিতে পেটে ভাতে কাজ করে তার বিনিময়ে পুরো ফসলটা জমিদারের গোলায় তুলে দেয়া। জমিদারের বরকন্দাজরা খুবই কড়া মনোভাবের। খাজনা না দিয়ে উপায় নেই এবং মহাজনী ঋণের সাথে এই ঋণের কোনো তফাত নেই।
গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা সরদার আমিন তার ‘গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস : একজন প্রত্যক্ষদর্শীর দৃষ্টিতে’ বইয়ে লিখেছেন, একটা সময়ে এসে তথাকথিত ধনী হয়ে ওঠা এই দরিদ্ররা ঋণের টাকায় ক্রয় করে টেলিভিশন, সাইকেল, ব্যবহার্য নানা উপকরণ আর বিয়েবাড়িতে দাওয়াতে গিয়ে উপহার দেয় বেশ দামি কোনোকিছু। অনেকটা জাতে ওঠার মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে যাতায়াত ও খাওয়াদাওয়ায় খরচ করে বেহিসেবী। আসলে বিষয়টা যেন এমন—কত যুগ বঞ্চিত থেকেছি, সব পুষিয়ে নেব।
গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতার সংখ্যা হু হু করে বেড়ে ৯০ দশকের শেষে ২২ লক্ষ পরিবার হয়েছে। মাসে দেড় থেকে দুইশ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ হচ্ছে—রহস্যটা কী? ১৪ বা ১৫% সুদে টাকা নিয়ে কত ব্যবসায়ী, মিল মালিক সুদের ভারে পথে বসে আছে। আর নিদেনপক্ষে ২৬.৫০% সুদে টাকা খাটিয়ে গরিব মানুষ দিন দিন চাঙ্গা হচ্ছে কীভাবে?
কাজেই ক্ষুদ্রঋণ থেকে যত দূরে থাকবেন তত ভালো। দরিদ্র আছেন, খেতে পারছেন না—এটা একটা কষ্ট। আর লোন নিয়েছেন বলে সকাল-বিকাল পাওনাদাররা বাড়ি এসে হানা দিচ্ছে, জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে, লোকজন জড়ো করে গালি দিচ্ছে—এটা আরেকরকম।
আর ক্ষুদ্রঋণ নেয়া হচ্ছে কড়াই থেকে চুলোয় ঝাঁপ দেয়া। ঋণের জালে একবার জড়িয়ে পড়লে ঋণ ও সুদচক্র আপনাকে সর্বস্বান্ত করে ছাড়বে। এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে।