প্রশ্নঃ পেশাজীবী বা বৃত্তিজীবীদের সফলতার দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত?
উত্তরঃ পেশাজীবী অর্থাৎ ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, ল-ইয়ার, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট বা কনসালটেন্ট হিসেবে যখন একজন স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত থাকেন তখন সেখানে সাফল্য অর্জনের জন্যে চারটি বিষয় প্রয়োজন।
- প্রথমত, উদ্যম—নতুন কিছু, বড় কিছু করার।
- দ্বিতীয়ত, পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা।
- তৃতীয়ত, পেশার প্রতি ভালবাসা, আন্তরিকতা, দায়িত্ব পালনে বিশ্বস্ততা।
- চতুর্থত, জনসংযোগ বা পরিচিতি।
এই চারটি বিষয় যদি একজন পেশাজীবী আয়ত্ত করেন, তিনি শুধু বৈষয়িকভাবে সফল হবেন তা নয়, একজন সৃজনশীল কীর্তিমান পেশাজীবী হিসেবেও স্মরণীয় হবেন।
কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের অধিকাংশ পেশাজীবী বিপুল অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে সাফল্যের এ শর্তগুলো অবহেলা করেন। ফলে একসময় পেশাজীবীদের যে মর্যাদার চোখে দেখা হতো এখন তা অনেকটাই দুর্লভ।
যেমন, ৭০-এর দশক পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ছিলেন যাদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয়। কিন্তু এরপর থেকে পট বদল হতে লাগল। জ্ঞানচর্চায় ব্রতী ছাত্র অন্তঃপ্রাণ শিক্ষকের জায়গায় এসে দাঁড়াল অর্থোপার্জনের নেশায় পাগল দিনমান প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটতে ব্যস্ত শিক্ষক নামের কিছু আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহার করতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না। যদিও এখনো অনেক শিক্ষক আছেন যারা সত্যিকার অর্থেই শ্রদ্ধেয়—তাদের গভীর জ্ঞান, পান্ডিত্য, ব্যক্তিত্ব এবং আদর্শের জন্যে।
কিন্তু এখনকার সাধারণ প্রবণতা হলো, রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতে ব্যস্ত শিক্ষক সুযোগ পেলেই ক্লাস বর্জন, ধর্মঘট, রাস্তায় আন্দোলন ইত্যাদির ঘোষণা দেন। এতে ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞানার্জনে পিছিয়ে পড়ুক কিংবা সেশন জটে আটকে পড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ুক—তাতে তাদের কিছু আসে যায় না।
মজার ব্যাপার হলো, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস না নিয়ে মহা উৎসাহে ধর্মঘট পালন করলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক সময়েই তিনি হাজিরা দেন। যেখানে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তার ছাত্ররা পড়ছে—সেখানে তিনি এ জাতীয় আন্দোলনের কথা দূরতম কল্পনাতেও আনতে পারেন না।
আসলে একজন পেশাজীবী শিক্ষক হতে পারেন বা ডাক্তার হতে পারেন। কিন্তু নীতিগতভাবে তিনি কখনো বলতে পারেন না যে, আমি পড়াব না বা আমি রোগী দেখব না—যতক্ষণ তিনি একজন শিক্ষক বা ডাক্তার হিসেবে নিয়োজিত আছেন। যে-কোনো সময় সেবা দেয়ার জন্যে তাকে প্রস্ত্তত থাকতে হবে।
ধরুন, একজন দর্জি, পোশাক তৈরি করেন। এটাও একটা স্বাধীন পেশা। তাকে প্রত্যেকের মাপমতোই পোশাক তৈরি করতে হবে। মি. এক্স-এর মাপে মি. ওয়াই-এর পোশাক বানালে কি হবে? অথবা যে সময়ের মধ্যে পোশাক তৈরি করে দেয়ার কথা, তার অন্তত একদিন আগে পোশাকটি তৈরি করে রাখতে হবে, যাতে ক্লায়েন্ট আসার সাথে সাথে তাকে দিয়ে দিতে পারেন। আর দুইদিন আগে করে রাখতে পারলে আরো ভালো।
আর একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের এটা কখনো ভুলে যাওয়া উচিত নয়, আজকে তার এই অবস্থান তৈরির জন্যে কত নিরন্ন মানুষের ট্যাক্সের টাকায় তিনি প্রায় বিনা পয়সায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। শুধু তা-ই নয়, তার বেতনের অর্থায়নও হয় এই ট্যাক্সের টাকায়। নিজের বিবেকের কাছেই তার জিজ্ঞেস করা উচিত—এই ঋণ বা দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তির কতটা চেষ্টা তিনি করেছেন। ক্লাস বর্জন বা ক্লাস ফাঁকি দেয়ার ফলে তার ঋণের বোঝা কি দিনে দিনে আরো বাড়ছে না?
হাঁ, যদি এমন হয় যে, পারিপার্শ্বিক কারণে তিনি ঐ পেশায় কোনোভাবেই মানিয়ে নিতে পারছেন না, তখন হয়তো ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে যতক্ষণ একটি জায়গায় সেবাদানের চুক্তিতে তিনি আবদ্ধ ততক্ষণ ঐ দায়িত্বই তাকে পালন করতে হবে চূড়ান্ত নিষ্ঠার সাথে। যখন যা খুশি করার কোনো অধিকার তার তখন থাকে না বা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে যাওয়ার দ্বৈত নীতি অনুসরণ করার সুযোগও আর থাকে না। তা করলে তিনি তার শপথেরই লঙ্ঘন করলেন। আসলে পেশাজীবন শুরুর আগে প্রত্যেক পেশাজীবীকেই পেশার কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য মেনে চলার অঙ্গীকার করতে হয়। সেটা ঘোষিত হতে পারে বা হতে পারে অঘোষিত।
যেমন, আমরা জানি—একজন চিকিৎসক যখন তার পেশাজীবন শুরু করেন, তাকে ‘হিপোক্রিটিক ওথ’ নামে একটি শপথ নিতে হয়, যেখানে তিনি নিজের সীমাবদ্ধতাকে স্মরণে রেখে বিনয়ের সাথে একজন রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্যে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার প্রতিজ্ঞা করেন। ওষুধ বা সার্জারির চেয়েও রোগীর জন্যে তার একটু মমতা, একটু সহানুভূতি অনেক সময় বেশি কাজ করতে পারে এটা মনে রাখার অঙ্গীকার তিনি করেন। এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো, অসুস্থ হলে একজন মানুষ শুধু যে শারীরিকভাবেই আক্রান্ত হয় না, তার পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক জীবনও যে প্রভাবিত হয়, চিকিৎসার সময় এ বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দেয়ার অঙ্গীকার তিনি করেন।
যে-কোনো পেশাজীবী যখন তার পেশাগত অঙ্গীকার পালনে ব্যর্থ হবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি শ্রদ্ধা হারাবেন। কারণ শুধু পদ-পদবি বা কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানে থাকলেই শ্রদ্ধা পাওয়া যায় না। শ্রদ্ধা পাওয়ার জন্যে ব্যক্তিকেই কাজ করতে হবে সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে।
আর বৃত্তির ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বস্ততা বলতে বোঝায়—ধরুন, আপনি পরার্মশ দিচ্ছেন একজনকে। পরামর্শদাতা হিসেবে আপনাকে বিশ্বস্ত হতে হবে। যদি আপনি বিশ্বস্ত না হন, যারা পরামর্শ নিতে আসছেন তারা যদি মনে করেন যে, সে যা বলছে তা আপনি কাউকে বলে দিতে পারেন। তাহলে পরামর্শদাতা হিসেবে আপনি ব্যর্থ হবেন। কেউ আপনার কাছে পরামর্শের জন্যে আসবে না। তাই আপনাকে আপনার পেশার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে।
Related Posts
Q&A Series – Episode 292: Failure is the pillar of success!
Q&A Series – Episode 291: What exactly is visualization?
Q&A Series – Episode 290: How does visualization work?