Business Care News

Business News That Matters

social, media, addiction, chasing

Photo by Pixabay

প্রশ্নোত্তর সিরিজ – পর্ব ২৫২: সন্তান যখন ইন্টারনেট, ফেসবুক এবং গেমসে আসক্ত

প্রশ্নঃ আমাদের ভুলের কারণে সন্তান অনেক আগে থেকেই ইন্টারনেট ফেসবুক এবং গেমস-এর আসক্তিতে ভুগছে। পড়াশোনাকে ভয় পাচ্ছে। মোটেও পড়াশোনা করছে না। এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী?


উত্তরঃ এই সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। ইন্টারনেট, ফেসবুক এবং গেমস-এ আসক্ত হলে মানুষের মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা কমে যায়। তখন পড়াশোনাকে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। যেহেতু সে আপনার সন্তান, আপনাকে হাল ছাড়লে চলবে না। তাকে বেশি বেশি সময় দিন। পরবর্তী ৪০ দিন দুবেলা করে তাকে কমান্ড সেন্টারে এনে বোঝান এবং বাস্তবে তার সাথে খোলামেলা কথা বলুন। তার জন্যে জান-ই সদকা দিন। সদকা হিলিংয়ে নাম দিন এবং তাকে কমান্ড সেন্টারে এনে ক্রমাগত নিজে হিলিং করুন।

সেইসাথে নিজে সচেতন হোন। রাত ১১টার পরে কোনো ফেসবুক, ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন না। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শিখাও।’ আপনি ইন্টারনেট ফেসবুকে ব্যস্ত থাকবেন আর সন্তানকে বলবেন, তোমার ফেসবুক বন্ধ করো। হবে না তো। অতএব আগে নিজেরা বাঁচুন, তাহলে সন্তানকে প্রভাবিত করা সহজ হবে।

আসলে এখন ফেসবুক-ইন্টারনেট-ভিডিও গেমের যে আসক্তি দেখা দিয়েছে, তা মাদকাসক্তির চেয়েও ভয়াবহ। ব্রিটেনে ডিজিটাল টেকনোলজি এডিকশনের জন্যে ১২-১৫ বছরের বাচ্চাদেরকে রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি করানো হচ্ছে। ড্রাগ রিহ্যাব সেন্টারের মতো এখন ইউরোপ আমেরিকাতে স্মার্টফোন রিহ্যাব শুরু হয়েছে।

মানবজমিনে ‘ভিডিও গেমসের ভয়ংকর নেশা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ড্রাগের নেশা কাটাতে মানুষ যেমন হাসপাতালে ভর্তি হয়, তেমনি ভিডিও গেমস খেলার নেশা কাটাতে ভারতীয় এক পরিবার তাদের সন্তানদের হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। দিল্লির ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর গেমে আসক্ত হয়ে প্রচণ্ড ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করত পরিবারের সঙ্গে। পড়াশোনারও অবনতি হচ্ছিল দিন দিন, ওজন বেড়ে যাচ্ছিল দ্রুত। তখন তার মা-বাবা ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করায়। ভিডিও গেমস খেলার মধ্যে বার বার বিরক্ত করছিল বলে টেক্সাসে এক লোক তার পাঁচ বছর বয়সী কন্যাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। কী মারাত্মক এই গেমসের নেশা!

ঘরে ঘরেই শিশু-কিশোর আর তরুণরা এর শিকার হচ্ছে। পরিণামে তাদের একটা বড় অংশই বিষণ্নতা ও হতাশায় ভুগছে। তাদের জীবনে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। ফলে তাদের বিভ্রান্তির পথেও নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে খুব দ্রুত। আসলে ভিডিও গেম জুয়ার আধুনিক রূপ ছাড়া কিছু নয়। আগেরকালে সমাজপতিরা সমাজের সাধারণ মানুষকে মাতিয়ে রাখত যাতে তারা নিজেদের কথা বা সমাজের কথা ভাবতে না পারে, নৈতিক এবং আত্মিক উন্নয়নের জন্যে যাতে তারা সময় না পায়। এখনকার এসব ভিডিও গেমস বা কম্পিউটার গেমসও তা-ই।

এখন এগুলোর আরো আধুনিক সংস্করণ বেরিয়েছে, যাতে শুধু ঘরে বসে খেলাই না, জানোয়ার খোঁজার জন্যে বাইরেও বেরিয়ে পড়তে হবে তাকে। সার্ভার দিয়ে যারা গেম পরিচালনা করছে, তারাই নাকি জঙ্গলে এসব কল্পিত জানোয়ার খোঁজার জন্যে ঘরের বাইরে বের করছে গেমারদের। তা করতে গিয়ে হয় দুর্ঘটনায় পড়ছে এরা, নয়তো ছিনতাইকারী বা অপহরণকারীর কবলে পড়ছে। কিন্তু গেমের নেশা এমনই যে, আহত অবস্থায়ও সে কল্পিত জানোয়ারের পেছনে ছুটছে, চিকিৎসার জন্যে না গিয়ে। ফলে মারাও গেছে কয়েকজন। পত্রিকার শিরোনাম হলো ‘গেম খেলে মরছে মানুষ’।

তারপর ফেসবুক এবং আরো সব তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তরুণদের নৈতিকতা বিকাশের সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে এখন এটাকে মনে করা হচ্ছে! যুক্তরাজ্যে ১৭০০ অভিভাবকের ওপর চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৫% অভিভাবকই বলছেন, সন্তানের নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে তারা মনে করছেন এইসব সোশাল মিডিয়াকে। কারণ এসব মিডিয়াতে সেলফি তোলা, লাইক দেয়া, স্ট্যাটাস আর আপডেট দিতেই চলে যাচ্ছে তাদের সব সময়।

আসলে সেলফি তোলা যখন আসক্তি হয়ে যায়, তখন এটা একটা রোগ—সেলফি সিনড্রোম বলা যেতে পারে। অর্থাৎ আমারটা আগে, আমি অন্য কিছু বুঝি না। আর এর পরিণতি হলো হতাশা। কারণ আত্মকেন্দ্রিকতা অতৃপ্তির জন্ম দেয়। নিজের কত রকম ছবি আপনি তুলতে পারবেন? বেশি যখনই তুলবেন, তুলতে তুলতে কী হবে? অতৃপ্তি।

সম্প্রতি টাইম ম্যাগাজিনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে মার্কিন টিনএজারদের সেলফি সিনড্রোম বা আত্মকেন্দ্রিকতা নিয়ে। বলা হচ্ছে, অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে মার্কিন যুবসমাজ এখন অনেক বেশি স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক। ৫৮% টিনএজারই এখন বড় হচ্ছে স্বার্থপরতা আর আত্মকেন্দ্রিকতা নিয়ে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেমরোগ বলে!

আর এর পরিণতিও খুব করুণ! স্কুলে গুণ্ডামি আর ঠকবাজি এবং পরিণামে অসুখী হওয়াই এখন এদের নিয়তি। সহপাঠীদের হাতে অত্যাচারিত হবার কারণে আমেরিকায় প্রতি পাঁচ জনে একজন হাইস্কুল ছাত্র আত্মহত্যা করার কথা ভাবে। ৭০% কলেজছাত্র স্বীকার করেছে কখনো না কখনো তারা স্কুলের সহপাঠীদের সাথে প্রতারণা করেছে। আর তিন ভাগের একভাগ শিক্ষার্থীই ভুগছে এত মারাত্মক বিষণ্নতায় যে, পড়াশোনাসহ অন্যান্য কাজে মনোযোগ দেয়া তাদের জন্যে কঠিন হয়ে পড়েছে!

তাই প্রযুক্তি আর বিনোদনের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে সন্তান যেন আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। তাকে পরিবারের অংশ হিসেবে বড় করে তুলুন। তাকে ভালবাসুন। তার প্রতি মনোযোগ দিন। সন্তানকে তার জীবনের লক্ষ্য দিন। কারণ জীবনের লক্ষ্য যদি সুস্পষ্ট হয়, তাহলে সেই সন্তানকে কেউ বিভ্রান্ত করতে পারে না। তার মধ্যে কখনো হতাশা আসবে না। এজন্যে আমরা বলি, একটি লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে সন্তানের প্রতি মা-বাবার সবচেয়ে বড় উপহার। আর এটা আপনি তখনই দিতে পারবেন, যখন আপনার জীবনের লক্ষ্যও ঠিক হবে।

তাকে নৈতিক শিক্ষায় উজ্জীবিত করুন। এজন্যে আপনার নিজের জীবনেও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটান। আসলে সন্তানকে শুধু গোল্ডেন জিপিএ পাওয়ানোটা আপনার দায়িত্ব না। সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা বা ভালো-মন্দের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে মূল দায়িত্ব, যে শিক্ষার মূল আকর হচ্ছে ধর্মগ্রন্থ। এই ধর্মগ্রন্থ সে যাতে উৎসাহ নিয়ে পাঠ করে, সেটা উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর সে উদ্বুদ্ধ হবে তখনই যখন দেখবে যে, আপনি নিজে সেটা করছেন এবং ধর্মগ্রন্থের মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার প্রতিফলন আপনার জীবনে ঘটছে। তাহলেই ভোগবাদী ব্যবস্থার ফলে সৃষ্ট আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভার্চুয়াল ভাইরাস থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করে আমরা সবার জন্যে বাঁচব।

মূল: প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড

Skip to content