প্রশ্নঃ স্বাধীন পেশায় যাওয়া বোকামি না তো? ক্যারিয়ার হিসেবে কী গ্রহণ করা উচিত-চাকরি না স্বাধীন পেশা? আমরা তো কেরানিগিরিতে অভ্যস্ত। আমাদের দ্বারা কি শিল্প বা ব্যবসায় ভালো করা সম্ভব?
উত্তরঃ স্বাধীন প্রতিটি পেশা-শিল্প ব্যবসা কৃষি-সবকিছুতেই ভালো করা সম্ভব। মুন্নু সিরামিকস বিশ্বে সিরামিকসের ক্ষেত্রে তিন নম্বর প্রতিষ্ঠান। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প এখন বৈদেশিক আয়ের মূল উৎস। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ার পরও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আজ থেকে ৪০০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রধানত তিনটি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন-ব্যবসা, শিল্প এবং কৃষি। কৃষিতে তাদের মেধা এত বিকশিত হয়েছিলো যে, ৩৫০ প্রজাতির ধান উৎপাদন করতেন তারা। যত ধরনের সুগন্ধি মশলা আছে সবই তারা উৎপাদন করতেন। শিল্পে তারা মেধাকে এত বিকশিত করেছিলেন যে, মসলিনের মতো সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি করতেন। টেক্সটাইল টেকনোলজির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন এই মসলিন। আজ পর্যন্ত তুলা থেকে এর চেয়ে মিহি কাপড় তৈরি করা সম্ভব হয় নি। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ আঁশের তুলা উৎপাদিত হতো যশোর ও বরেন্দ্র এলাকায়। আমাদের সওদাগরেরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতেন। চট্টগ্রামে জাহাজ তৈরি হতো। চট্টগ্রামে যে ‘বহদ্দার হাট’ রয়েছে সেটি ছিলো ‘বহরদার’ অর্থাৎ নৌবহরের দার বা প্রধানের জায়গা। আমাদের কারিগররা জাহাজ বানাতেন। সেই জাহাজে তারা জাভা, সুমাত্রা, মালদ্বীপ, সিংহল প্রভৃতি স্থানে যেতেন। বালিতে রামায়ণের নাটক অভিনয় তাদের সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। কারণ তাদের পূর্বপুরুষরা এই বাংলা থেকে গিয়েছিলেন। বাংলার বীর বিজয় সিংহ সিংহলের পত্তন করেন, সিংহল নাম তার নামানুসারেই। মধ্যযুগে ভাইকিংদের সাথে নৌযুদ্ধে এই বাংলা থেকে জাহাজ গিয়েছিলো। সমুদ্রযাত্রা আমাদের সংস্কৃতির এত অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলো যে, চাঁদ সওদাগরের কাহিনীর মতো লোকসাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে সেসময় আমাদের এই উপমহাদেশের জিডিপি ছিলো বিশ্বের জিডিপির ২২-২৩%। আর তখন ইংল্যান্ডের জিডিপি ছিলো বিশ্ব জিডিপির এক শতাংশ মাত্র। মুর্শিদাবাদ ছিলো লন্ডনের চেয়েও বড় শহর। লাহোরের অধিবাসীর সংখ্যা ছিলো ২০ লক্ষ। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে আমাদের পেশা সংক্রান্ত ধ্যানধারণা পরিবর্তিত হতে শুরু করলো। আমাদের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হলো যে, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সৃজনশীল কাজগুলো করার কোনো ক্ষমতাই আমাদের নেই। আমাদের অবস্থা দাঁড়ালো খাঁচায় আবদ্ধ পাখির মতো। এন্ট্রিপ্রিনিউরাল স্পিরিট (entrepreneurial spirit) হারিয়ে আমরা নিজেদেরকে শুধুমাত্র চাকরিজীবী অর্থাৎ চাকর ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে শুরু করলাম। যেখানে আমাদের সওদাগরেরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতো, সেখানে সৃষ্টি হলো কালাপানির ধারণা অর্থাৎ সমুদ্র যাত্রা যদি কেউ করে তো তার জাত চলে যাবে, জাতচ্যুত হবে। ফলে কালক্রমে আমরা পরিচিত হলাম দুর্ভিক্ষপীড়িত, বন্যা কবলিত, জরা-ব্যাধি জর্জরিত একটি জনপদ হিসেবে। স্বাধীন পেশায় যাওয়া নিয়ে আপনার যে হতাশা, যে বিভ্রান্তি-ক্যারিয়ার সংক্রান্ত এ হতাশা ও স্থবিরতার মূলে রয়েছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত অবক্ষয়। যত আমরা পূর্বপুরুষদের সেই সাহসী চেতনাকে, সেই উদ্যোগ ও উদ্যমকে জাগ্রত করতে পারবো, তত আমাদের মেধাকে আবারো শতধারায় বিকশিত করতে পারবো। নিজের অনন্য মেধাকে সেবায় রূপান্তরের মাধ্যমে নিজেই গড়তে পারবো পরিতৃপ্তিময় কর্মজীবন।
Related Posts
Q&A Series – Episode 292: Failure is the pillar of success!
Q&A Series – Episode 291: What exactly is visualization?
Q&A Series – Episode 290: How does visualization work?