প্রশ্নঃ প্রাচুর্যের জন্যে সঙ্ঘের গুরুত্ব কতটুকু?
উত্তরঃ আমাদের প্রাচুর্যের ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে, ক্ষুদ্র স্বার্থপরতার বৃত্ত। আমরা মনে করি, সব সুখ সম্পদ প্রাচুর্য আমি একা ভোগ করবো-আর কেউ না। এটা করতে গিয়ে আমরা আসলে কিছুই করতে পারি না। নিজেও প্রাচুর্য পাই না এবং চারপাশের মানুষকেও প্রাচুর্যের সন্ধান দিতে পারি না।
আসলে বড় কিছু করতে চাইলে সঙ্ঘবদ্ধতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। আপনার স্বপ্ন, আপনার চিন্তা বাস্তবায়নের জন্যে হাজারো মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারলেই আপনি বড় হবেন। এখানেই সঙ্ঘায়নের গুরুত্ব। সঙ্ঘায়ন ‘আমি’কে ‘আমরা’য় বদলে দেয়। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ লীন হয়ে যায় সামগ্রিক কল্যাণে। ফলে সংশ্লিষ্ট সবার প্রাপ্তির পরিমাণ হয় বহুগুণ। কারণ এক মাথার চেয়ে দুই মাথার জ্ঞান বেশি। দুইয়ের চেয়ে তিন-এর। সঙ্ঘায়নে বহু মস্তিষ্ক একাত্ম হয়ে উচ্চমাত্রার সৃজনশীলতা, শক্তি ও প্রেরণার নতুন উৎসে রূপান্তরিত হয়। সঙ্ঘায়নে সৃষ্টি হয় সিস্টেম ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা-সৃষ্টি হয় গতিশীল নেতৃত্ব ও কর্মপন্থা। কারণ পাঁচ হাজার লোকের একটা ফ্যাক্টরি করতে চাইলে আপনাকে পাঁচ হাজার মানুষকে ম্যানেজ করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
ম্যানেজেরিয়াল ক্যাপাসিটির অভাবে কী হয়-তার একটি বড় উদাহরণ আদমজী জুট মিল। স্বাধীনতার পরে আমরা এই বিশাল মিলের অধিকারী হলাম, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এটি পরিণত হলো শ্বেত হস্তিতে। বিশাল সেই জায়গায় এখন ইপিজেড অবস্থিত।
আমাদের কোম্পানিগুলো বড় হতে পারে না, কারণ আমরা নাম দেই কোম্পানি কিন্তু আচরণ করি তালুকদারের, ম্যানেজারের নয়। আমরা ধমকাই, সবকিছু নিজের মতো চালাতে চাই। কিন্তু ম্যানেজ করতে পারি না। ফলে তিনজনের একটা কোম্পানি হলে পাঁচ বছরের মধ্যে এটা কমসে কম চারটা কোম্পানি হয়ে যায়। ১০ জনের একটা দল হয়ে যায় তিনটা দল।
অথচ ইউরোপ-আমেরিকায় তা নয়। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো আমাদের কীভাবে শোষণ করছে এর খুব ছোট্ট উদাহরণ-গ্লাক্সো। ৩০ বছর আগে এটা শুধু গ্লাক্সো ছিলো, তারপরে বারোজ ওয়েলকামের সাথে মার্জ হয়ে হলো গ্লাক্সো বারোজ ওয়েলকাম। তারপর স্মিথক্লাইনের সাথে মার্জ হয়ে হলো গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন। সারা দুনিয়াতে এখন টিকার একচেটিয়া ব্যবসা তাদের।
তালুকদারি মনোভাবে মালিকই সবকিছু। আর কর্পোরেট কালচারে সবকিছুর ঊর্ধ্বে সিস্টেম। এই সিস্টেম তখনই ডেভেলপ করে, নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনার গুণাবলি তখনই বিকশিত হয় যখন সঙ্ঘায়ন হয়। সঙ্ঘায়ন ছাড়া, সঙ্ঘ ছাড়া মেধার চূড়ান্ত বিকাশ কখনো হয় না। আমরা যখন সঙ্ঘের মাধ্যমে আমি-কে আমরার মধ্যে লীন করে দেই তখন শক্তির আসল ফল্গুধারায়, বিশ্বাসের পর শক্তির যে দ্বিতীয় স্তর-সেখানে প্রবেশ করি।
সঙ্ঘায়ন মানুষকে সুশৃঙ্খল করে। সাধারণভাবে আমাদের আচরণ কথা বা কাজের ওপরে কোনো লাগাম থাকে না। কিন্তু সঙ্ঘের অংশ হলে তার আচরণ, কাজ ও সময়ের সুবিন্যাসায়ন হয়। সে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বুঝতে পারে, আমি এই আচরণ করতে পারবো, আর এই আচরণ করতে পারবো না-একটা সুন্দর কর্মপ্রক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
দুজন মানুষ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন আল্লাহর রহমত তাদের ওপর বর্ষিত হয়। তখন তারা আর দুইজন থাকে না, তিনজন হয়। সঙ্ঘশক্তির ক্ষেত্রে গাণিতিক নিয়ম খাটে না। অর্থাৎ ১+১=২ নয়, তখন ১+১=কমপক্ষে ৩, কোয়ান্টাম স্তরে ১+১=১১। অর্থাৎ ১১ জন লোক বিক্ষিপ্তভাবে যা করতে পারে সঙ্ঘবদ্ধ দুইজন তার চেয়ে বেশি করতে পারবে। কারণ সংখ্যা শক্তি নয়, শক্তি হলো এক চেতনায় বিশ্বাস এবং সঙ্ঘবদ্ধতায়।
সঙ্ঘ সবসময় একটি মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে গঠিত হয়। সমচেতনায় বিশ্বাসীরা যখন মহান লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয় সেখানে বিভিন্ন মেধা, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার বিকাশ ঘটে। প্রত্যেকের জ্ঞানের পরিধি বাড়তে থাকে। এজন্যেই বড় কিছু করতে হলে সবসময় সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে।
মহামানবরা সঙ্ঘের এই গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন বলেই সাধনার একটা পর্যায় শেষে তারা লোকালয়ে ফিরে সঙ্ঘ গড়েছেন। বোধি লাভের পর শত শত ভিক্ষু নিয়ে মহামতি বুদ্ধ গড়েছিলেন ভিক্ষুসঙ্ঘ। বুদ্ধ মন্ত্রের তৃতীয় বাক্য হচ্ছে, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি! স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশন। ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র গড়েন সৎসঙ্ঘ। নবীজী (স) নবুয়ত লাভের আগেই সমাজসেবার জন্যে তরুণদের নিয়ে গঠন করেছিলেন ‘হিলফুল ফুযুল’। তিনি বলেছেন, তোমরা সঙ্ঘবদ্ধ থাকো, কারণ সঙ্ঘের সাথে আল্লাহর রহমত থাকে। হযরত ওমরের (রা) সময় বিশাল রাজত্বের ১১টি প্রদেশের গভর্নরের মধ্যে সাতজনই ছিলেন হাবশি ক্রীতদাস। অতি সাধারণ মেধার মানুষও সঙ্ঘের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার পরে যে মেধার অসামান্য বিকাশ ঘটাতে পারেন, নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করতে পারেন-এটাই তার প্রমাণ।
তথ্যসূত্রঃ প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড
Related Posts
Q&A Series – Episode 292: Failure is the pillar of success!
Q&A Series – Episode 291: What exactly is visualization?
Q&A Series – Episode 290: How does visualization work?