Business Care News

Business News That Matters

running, woman, track

Photo by Pixabay

প্রশ্নোত্তর সিরিজ – পর্ব ২৬০: গ্রাউন্ড জিরো ও শ্রমানন্দ

প্রশ্নঃ আপনি গ্রাউন্ড জিরো ও শ্রমানন্দের কথা বলেন। আমি তো জিরোতে নাই-ই, বরং মাইনাস-এ আছি। আমার পারিপার্শ্বিক ও আর্থিক প্রতিবন্ধকতা আছে। সেইসাথে আছে কিছু শারীরিক প্রতিকূলতা। পরিশ্রমের কথা বাদ দিলাম, কোনো কিছুতেই আনন্দ পাই না। আমার পক্ষে কি কিছু করা সম্ভব?


উত্তরঃ মাইনাসে থাকলে তো আরো ভালো। আপনার তো আর নতুন করে কিছুই হারানোর নেই। যার হারানোর কিছু নেই, তিনিই নিশ্চিত মনে সামনে এগুতে পারেন। কারণ তার কোনো পিছুটান থাকে না।

এই মাইনাসটাকেই গ্রাউন্ড জিরো ধরুন। এখান থেকেই শুরু করুন। শতকরা ৯০ জন সফল মানুষই আর্থিক পারিবারিক পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতা নিয়ে মাইনাস অবস্থায়ই জন্মগ্রহণ করেছেন। তারা সেখান থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে সাফল্যের পথে এগিয়ে গেছেন। আর্থিক ও পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতাই তাদের ভেতরের শক্তির জাগরণের কারণ হয়েছে।

দৈহিক কোনো প্রতিবন্ধকতা ও সফলদের সাফল্যগাথা রচনায় অন্তরায় হতে পারে নি। মহাকবি হোমার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছিলেন। অমর সুরস্রষ্টা বেটোভেন জীবনের শেষ বছরগুলোয় কানে কিছুই শুনতেন না। কলকাতার মাসুদুর রহমান দুই পা কাটা পড়ার পরও ইংলিশ চ্যানেলে সাঁতার কেটে ১৯৯৫ সালে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছেন।

ফরাসি নাগরিক ফিলিপ ক্রেইজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কনুই থেকে দুই হাত ও দুই পা হারান ১৯৯৪ সালে। পঙ্গু হয়ে বাড়িতে থাকাকালে সাঁতারুদের ওপর এক তথ্যচিত্র দেখে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। শুরু হয় প্রস্ত্ততি। দুই বছর ট্রেনিং নেন। ৪২ বছর বয়সে ২০১০ সালে ঘণ্টায় তিন কিলোমিটার গতিতে ১৩ ঘণ্টায় ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন। সৃষ্টি করেন হাত এবং পা ছাড়া সাঁতার কাটায় নতুন ইতিহাস।

১০ এপ্রিল, ২০১০-দৈনিক ইত্তেফাকের একটি রিপোর্ট ছিলো-সহপাঠীরা বেঞ্চে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে। পাশেই মেঝেতে চটে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে প্রতিবন্ধী কফিল উদ্দিন। তার দুই হাত-পা থেকেও নেই। এসএসসি পাশ করার পর অভাবের কারণে চট্টগ্রামে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে যায় সে। সেখানে একটি ভবনের ছাদে রড বাঁধাই করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত বিদ্যুতের তারে রড লাগার সাথে সাথে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারায়। চিকিৎসার সময় দুই হাতের কনুই ও দুই পায়ের হাঁটুর নিচ পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়।

গ্রামের বাড়িতে ফিরে সে মায়ের ছোট্ট মুদির দোকানে কাজ করে। লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিলো প্রবল। প্রথমে মুখে কলম নিয়ে লেখার চেষ্টা করে, হয় না। পরে দুই কনুইয়ের মাঝখানে কলম ধরে লেখার চেষ্টায় তিন বছরে সফল হয়। এখন সে দ্রুত লিখতে পারে। এইচএসসি পরীক্ষার শতভাগ উত্তর সে নির্ধারিত সময়েই লিখেছে। লেখাপড়া শেষ করে সে বিচারক হতে চায়।

সীমাবদ্ধতা কীভাবে শক্তি হতে পারে, প্রতিবন্ধিত্বও কীভাবে সাফল্যের উৎস হতে পারে এ নিয়ে জেনের বিখ্যাত গল্প রয়েছে-

এক জাপানি বালক। ১৩ বছর তার বয়স। একটা দুর্ঘটনায় বাম হাত হারিয়ে ফেললো। তার ছিলো জুডো শেখার প্রচন্ড আগ্রহ। কিন্তু যেহেতু তার বাম হাত নেই, কোনো জুডো-গুরু তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হলেন না-বাম হাত নেই, একে কী শেখাবো? জুডো তো একটা সাংঘাতিক ব্যাপার! যেটার জন্যে দুটো হাতের প্রয়োজন।

ছেলেটি এই গুরুর কাছে যায়, ঐ গুরুর কাছে যায়। সবাই শুধু বলে যে, না, তুমি জুডো শিখতে পারবে না। তোমার জন্যে এগুলো নয়। তুমি বরং অন্য কিছু কর। কিন্তু বালক বিশ্বাসে অটল। বাম হাত নেই তাতে কী? জুডো সে শিখবেই। ঘোরাঘুরি করতে করতে শেষমেশ সে এক বয়োবৃদ্ধ গুরুর সন্ধান পেলো। বালকের শেখার আকুতি দেখে গুরুর মায়া হলো। তিনি তাকে বললেন যে, ঠিক আছে, আমি তোমাকে শেখাবো। তবে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, আমি যা বলবো তা তুমি মানবে এবং লেগে থাকবে।

শুরু হলো তার জুডো শেখা। দিন গেল, সপ্তাহ গেল, মাস গেল। বছর পার হলো। একসময় ছেলেটি অবাক হয়ে লক্ষ করলো-প্রতিদিন তার গুরু তাকে একটা কৌশলই, জুডোর একটি প্যাঁচই কেবল শেখাচ্ছেন। ডান-বাম, সামনে-পেছনে আর কিছুই না, শুধু একটাই কৌশল, একটাই প্যাঁচ।

একসময় তার মনে প্রশ্ন জাগলো, দুঃখ হলো-জুডোর এত প্যাঁচ আছে, সব বাদ দিয়ে গুরু আমাকে শুধু একটি প্যাঁচ শেখাচ্ছেন? আবার সাহসও পায় না যে, গুরুর সামনে বললে আবার না বেয়াদবি হয়ে যায়।

একদিন সাহস করে বলেই ফেললো যে, সেনসেই! (জুডো-গুরুকে শিষ্যরা সম্মান করে ডাকে সেনসেই) আমি কি আর কোনো কৌশল শিখবো না?-বললো খুব করুণ স্বরে। গুরু জবাব দিলেন, তুমি একটি কৌশল শিখছো আর এই একটি কৌশলই, একটি প্যাঁচই তোমার ভালোভাবে রপ্ত করা দরকার। অতএব একাগ্রচিত্তে অনুশীলন করে যাও।

গুরু বলে দিয়েছেন। তার কাছে এটুকুই যথেষ্ট। যেহেতু গুরু তাকে খুব স্নেহ করেন, একটা প্যাঁচই মমতার সাথে বার বার বার বার শেখাচ্ছেন-সে অনুশীলন করে চললো। পাঁচ বছর পার হয়ে গেল এই একটা প্যাঁচ শিখতে। দীর্ঘ অনুশীলনে এই প্যাঁচের সবকিছু দারুণভাবে রপ্ত করলো সে।

এবার গুরু সিদ্ধান্ত নিলেন তাকে প্রতিযোগিতায় নামানোর। প্রতিযোগিতা শুরু হলো। প্রথম দুই ম্যাচে খুব অনায়াসে সে ঐ এক প্যাঁচ দিয়েই দুজনকে হারিয়ে দিলো। এবার ফাইনাল। ফাইনাল ম্যাচে সে সত্যি সত্যি বেশ বেকায়দায় পড়লো। কারণ তার প্রতিপক্ষ বেশ শক্তিশালী আর অভিজ্ঞ।

একসময় মনে হলো যে, বালকটি বোধহয় হেরে যাচ্ছে। ভীষণ মার খাচ্ছে। রেফারিও বুঝতে পারছে না খেলা কি চলতে দেবে, না থামিয়ে দেবে। কারণ যেভাবে ছেলেটি মার খাচ্ছে তাতে যেকোনো সময় সে পড়ে যেতে পারে। কিন্তু তার গুরু ইশারা করলেন যে, না, খেলা চলুক।

বিরতি হলো। গুরু বালকের মাথায় হাত বুলিয়ে উৎসাহ দিলেন। সুন্দর খেলছো। তুমি জিতবে। খেলা আবার শুরু হলো। শক্তিমান প্রতিপক্ষ অধৈর্য হয়ে উঠলো। মরিয়া হয়ে আক্রমন করতে লাগলো। বালক ঠান্ডা মাথায় প্রতিটি আক্রমন কাটাচ্ছে। হঠাৎ প্রতিপক্ষ একটা ভুল করার সাথে সাথে বালক তার প্যাঁচ প্রয়োগ করলো এবং জিতে গেল। বালক চ্যাম্পিয়ন হলো।

চ্যাম্পিয়ন হয়ে বালক তো মহাখুশি। এটা তার কাছেও বিস্ময়কর যে, একটিমাত্র কৌশল প্রয়োগ করে সে জিতে গেল! ফেরার পথে সে গুরুকে জিজ্ঞেস করলো যে, সেনসেই! এই একটিমাত্র কৌশল প্রয়োগ করে আমি জিতলাম কী করে?

তখন গুরু বললেন যে, দেখ, তুমি দুটি কারণে জিতেছো। এক হচ্ছে, তুমি জুডোর খুব দুরূহ একটি কৌশল, খুব কষ্টকর জটিল একটি প্যাঁচকে খুব ভালোভাবে শিখেছো। দুই হচ্ছে, আমার জানামতে এই প্যাঁচ থেকে বাঁচার জন্যে প্রতিপক্ষের একটিই পথ আছে। তা হলো প্রতিদ্বন্দ্বীর বাম হাত ধরে ফেলা। সে যদি তোমার বাম হাত ধরতে পারতো তাহলেই বাঁচতো। কিন্তু তোমার তো বাম হাতই নেই। অতএব তুমি জিতে গেছো।’

এই জাপানি বালকের মতো সীমাবদ্ধতাই হতে পারে আপনার শক্তি, হতে পারে আপনার বিজয়ের অনুঘটক। আসলে শারীরিক আর্থিক পারিবারিক বা পারিপার্শ্বিক-কোনো সীমাবদ্ধতাই সাফল্যের পথে অন্তরায় নয়, যদি আপনি সীমাবদ্ধতা নিয়ে হীনম্মন্যতায় না ভোগেন। কারণ হীনম্মন্যতা নেতিবাচকতার জন্ম দেয়। আর নেতিবাচকতার পরিণতি হচ্ছে হতাশা আর ব্যর্থতা।

আপনি শুধুমাত্র আপনার হীনম্মন্যতাকে জয় করুন। ভাবুন-এটা নাই, ওটা নাই তাতে কি! আমিও মানুষ। আমার একটা জীবন আছে, মস্তিষ্ক আছে, চিন্তা করার শক্তি আছে। ব্যস, আর কিছু দরকার নেই। বিশ্বাসকে প্রবল করুন। সাহসী হোন। লক্ষ্য স্থির করুন। নিরলস পরিশ্রম করুন। সাফল্য আপনার। আনন্দ আপনার। সারা পৃথিবী আপনার।

মূল: প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড

Skip to content