Business Care News

Business News That Matters

ai generated, brain, tree

প্রশ্নোত্তর সিরিজ – পর্ব ১১০: প্রজ্ঞাবান কে? প্রজ্ঞার গুরুত্বই বা কী?

প্রশ্নঃ প্রজ্ঞাবান কে? প্রজ্ঞার গুরুত্বই বা কী?


উত্তরঃ যিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সঠিক সিদ্ধান্তটি সঠিক সময়ে নিতে পারেন তিনিই প্রজ্ঞাবান।

প্রজ্ঞার গুরুত্ব অনেক। সুস্বাস্থ্যের পর স্রষ্টার সবচেয়ে বড় নেয়ামতই হলো এই প্রজ্ঞা। কারণ একজন মানুষের অর্থ, বস্তুগত সম্পত্তি ছিনতাই হতে পারে, বেদখল হতে পারে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু মানুষটির যদি প্রজ্ঞা থাকে তাহলে ছাই থেকেও তার পুনরুত্থান ঘটতে পারে। আর যদি প্রজ্ঞা না থাকে, তাহলে উত্তরাধিকারসূত্রে অনেক কিছু পাওয়ার পরও সে নেমে যেতে পারে নিঃস্ব, অসহায়ত্বের নিম্নতম স্তরে।

ইতিহাসেই রয়েছে এর দৃষ্টান্ত। উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তনও হয়েছিল প্রজ্ঞাহীনতার মধ্য দিয়ে। ইংল্যান্ডের রাজা জেমসের বিশেষ দূত হয়ে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে এসেছিলেন ইংরেজ কূটনীতিক টমাস রো।

উদ্দেশ্য-ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্যে বাণিজ্য—ছাড় আদায়। বছরের পর বছর তিনি সম্রাটের পেছনে ঘুরেছেন, উপহার-উপঢৌকন আর মিষ্টি কথা দিয়ে তার মন জয়ের চেষ্টা করেছেন।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের কন্যা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে হেকিম-কবিরাজ যখন রোগ সারাতে ব্যর্থ হলেন তখন টমাস রো একজন ইংরেজ ডাক্তার নিয়ে গেলেন—যার চিকিৎসায় জাহাঙ্গীরকন্যা সুস্থ হয়ে উঠলেন।

সম্রাট খুশি হয়ে পুরস্কার দিতে চাইলে টমাস রো নিজের জন্যে কিছু চান নি। তিনি তার স্বজাতির জন্যে শুল্কমুক্ত ব্যবসার সুযোগ চেয়েছিলেন। দিল্লীশ্বর সে সুযোগ তাকে দিলেন। পরবর্তী সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একচ্ছত্র রাজত্ব করল। ফরাসি, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ফিরিঙ্গিরা ইংরেজদের সাথে প্রতিযোগিতায় আর টিকতে পারল না। বাণিজ্য তো বটেই পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতাও তাদের পদানত হয়েছিল।

অর্থাৎ একই ঘটনায় একজনের প্রজ্ঞা এবং আরেকজনের প্রজ্ঞাহীনতার উদাহরণ আমরা দেখি। ইংরেজ টমাস রো যে ঘটনায় তার অসাধারণ দূরদৃষ্টি এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তিন শত বছর ধরে তার জাতিকে সম্পদ-ক্ষমতা ভোগের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, সেই একই ঘটনায় নিজেদের প্রজ্ঞাহীনতার পরিচয় দিয়ে মোঘলরা জাতির স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির বিনাশ করেছিল।

আসলে প্রজ্ঞা হলো তা-ই যা দিয়ে একজন মানুষ বুঝতে পারবে তার আজকের একটি সিদ্ধান্তের ফলাফল ৫/১০ বছর বা আরো পরে তার জন্যে কী পরিণতি নিয়ে আসবে-ভালো না মন্দ, কল্যাণ না অকল্যাণ।

যেমন, ছাত্রছাত্রীরা অনেক সময় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সাময়িক এক ধরনের মোহে আকৃষ্ট হয়। একটু বাঁকা চাহনি, একটু আবেগপূর্ণ কথা, একটু গুরুত্ব দেয়া—এসব দেখে মোহাবিষ্ট হয়, বাস্তব জ্ঞানশূন্য হয় বা অনৈতিক কাজ করে ফেলে। নষ্ট করে পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, পারিবারিক সম্পর্ক। কিন্তু তখন যদি সে একটু থেমে ভাবতো—তার এ আবেগ বা ঝোঁকের মাথায় নেয়া সিদ্ধান্তের পরিণতি কী হবে তাহলেই কিন্তু প্রেম-পাগলামিতে জড়িয়ে নষ্ট করত না জীবনের সম্ভাবনা।

আবার প্রজ্ঞা প্রয়োগ করে বাস্তব জীবনে জটিলতা বা সংঘাত এড়ানো গেছে এমন ঘটনাও প্রচুর। একটি বাস্তব ঘটনা। সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ ইবনে সউদের সময় যখন সৌদি আরবে টেলিফোন চালু করা হচ্ছিল, প্রবল বিরোধিতা আসতে লাগল কিছু ধর্মীয় নেতার কাছ থেকে।

কারণ যারা ধর্মান্ধ তারা তো সবসময় নতুন কিছুকে বেদাতবলে বাতিল করে দিতে চায়। অবশ্য বেদাত শব্দটার মানেই হলো নতুন কিছু। সেই হিসেবে সব নতুন জিনিসকেই বেদাতের দলে ফেলা যায়।

একজন আলেম ক্ষেপে গেলেন যে, না, এটা হচ্ছে ইহুদি-নাসারাদের ব্যবস্থা। এটা সৌদি আরবে চালু করা যাবে না। এখন বাদশাহ দেখলেন যে, মহাবিপদ। এরা যদি কোনো ফতোয়া দিয়ে দেয় তাহলে হয়তো আমার রাজত্বও চলে যেতে পারে।

বাদশা বুদ্ধি ঠিক করে ফেললেন। বললেন যে, এই পদ্ধতি আল্লাহ পছন্দ করবেন কি করবেন না এটা আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার। এজন্যে বাদশাহ প্রস্তাব দিলেন—যারা বিরোধিতা করছেন তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় একজন টেলিফোনের এক প্রান্ত থেকে কোরআন তেলাওয়াত করবেন। আর তাদেরই আরেকজনকে বললেন অপর প্রান্ত থেকে সেটা শুনতে। আর যদি শোনা যায় তাহলে সালাম দিতে। যদি দুজনই পরস্পরের কথা শুনতে পান তাহলে বোঝা যাবে যে, এতে আল্লাহর অনুমতি রয়েছে। কারণ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আল্লাহর কালাম এই তারের মধ্য দিয়ে যাবে না।

তারা সম্মত হলেন। কারণ যারা ফতোয়া দিয়েছেন তাদের তো টেলিফোন সম্পর্কে কোনো ধারণা নাই। নির্দিষ্ট দিনে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ চালু করা হলো। টেলিফোনের মধ্য দিয়ে সফলভাবে যখন কোরআন তেলাওয়াত করা ও শোনা গেল—তারা মেনে নিলেন যে, এতে আল্লাহর অনুমতি আছে। চালু হয়ে গেল টেলিফোন ব্যবস্থা।

বাদশাহ সউদের যদি প্রজ্ঞা না থাকতো তাহলে উনি কী করতেন? বিরোধে জড়িয়ে পড়তেন। দেখা যেত বিরোধিতার কারণে তাকে বাদশাহীও ছেড়ে দিতে হচ্ছে। কিন্তু উনি বিরোধ এড়ানোর জন্যে প্রজ্ঞার আশ্রয় নিলেন।

আরেকটি ঘটনা। এক লোক খেজুর গাছ থেকে পড়ে গেল। পড়-তো-পড় আরেক লোকের ওপরে। এবং যার ঘাড়ের ওপরে পড়েছে সে মারা গেল।

এখন মৃতের স্ত্রী রাজার দরবারে তার স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে আর্জি জানাল। রাজা দেখলেন, যেহেতু এটা একটা দুর্ঘটনা—হত্যাকারীর কোনো ইচ্ছাকৃত অপরাধ নয়, আর বিধবা মহিলাটিও দুস্থ, তাই মৃত্যুর বদলে মৃত্যুর চেয়ে কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ হওয়াটাই সবদিক থেকে মঙ্গলজনক।

রাজা রক্তঋণ শোধের প্রস্তাব দিলেন। তখন আরবে একটি প্রথা ছিল রক্তপণ। অর্থাৎ যে মারা গেছে তার নিকট-আত্মীয়রা টাকা পয়সা নিয়ে যদি সন্তুষ্ট হয় তাহলে তার মৃত্যুদন্ড মওকুফ হয়ে যেত।

কিন্তু মহিলা জিদ ধরল যে, আমার স্বামীকে যেহেতু মেরেছে মৃত্যুর শাস্তি মৃত্যু হতে হবে। রাজা যখন কিছুতেই তাকে বোঝাতে পারলেন না তখন বললেন যে, ঠিক আছে, তুমি যখন জিদ করছ, আইন অনুসারে তোমার স্বামীর যে হত্যাকারী তার মৃত্যু হবে।

তবে তোমার স্বামীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তুমিও তাকে একই পদ্ধতিতে হত্যা করবে। ঐ লোককে খেজুর গাছের নিচে বেঁধে রাখা হবে। তুমি খেজুর গাছে উঠবে, ওখান থেকে ঐ লোকের ঘাড়ে পড়বে।

মহিলা বলল যে, এটা কীভাবে হবে?

রাজা বললেন যে, দেখ, আইন তো সুবিচার চায়। তোমার স্বামীর যেভাবে মৃত্যু হয়েছে তুমি যেহেতু তোমার স্বামীকে ভালবাসো—তোমার স্বামীর হত্যাকারীকেও সেই একইভাবে হত্যা করতে হবে।

এখন মহিলা তো গাছে উঠতে পারে না। এই রকম লম্বা খেজুর গাছ। শেষে মহিলা যখন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করছে তখন রাজা বললেন, এখনো তোমার সুযোগ আছে। মহিলা তখন বলল, ঠিক আছে, তাকে মারলে তো আর আমার স্বামী ফেরত আসবে না। আমি রক্তপণই নেব।

এই যে দূরদৃষ্টি, এই যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটা পরিস্থিতিকে বুদ্ধিমত্তার সাথে মোকাবেলা করা—এটাই প্রজ্ঞা। যখন আপনার মধ্যে প্রজ্ঞা আসবে তখন সবসময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

তথ্যসূত্রঃ প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড

Skip to content