নীতির ভুলের কারণে একই পরিবার ও গ্রুপের কাছে কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা চলে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেছেন, ব্যাংক খাত অত্যন্ত সংবেদনশীল জায়গা। অর্থনীতির সঙ্গে এটি জড়িত। এটি এমন জিনিস না যে ভুল করে শিখতে থাকব। না বুঝেই বেশি ব্যাংক অনুমোদন দেয়া হয়েছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে গতকাল ‘ব্যাংকিং অ্যালমানাক’ গ্রন্থের পঞ্চম প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘প্রথম যখন বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হলো আশির দশকের শেষদিকে, তখন যে ভুলটা করা হয়েছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক – আইএমএফের পরামর্শে বেসরকারি খাতে ব্যাংকের অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংক চালাতে গেলে কী ধরনের কাঠামো, বিধিবিধান দরকার তা চিন্তা করিনি। সেই ভুল আবারো যেন আমরা না করি। আমরা যে ভুলটা করে ফেলেছি ব্যাংকের মতো আর্থিক খাতে অ্যান্টি মনোপলি পলিসি করিনি। যে কারণে শেয়ার কিনে একটি পরিবারের হাতে মালিকানা চলে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাত এমন খাত না যে ভুল করে আমরা শিখব। এখন প্রশ্ন উঠেছে, এ ব্যাংকগুলোকে আবার একত্রিত করে দেয়া হোক বা কমিয়ে দেয়া হোক। আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি, বাংলাদেশের মতো একটা দেশে এত ব্যাংকের জায়গা নেই। সেটা এতদিন পর আবার কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারল। ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়ে গেল।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাত অত্যন্ত সংবেদনশীল জায়গা। ১৯৯৭ সালে যখন প্রথম ব্যাংক রিফর্ম কমিটি হলো, তখন যারা ব্যাংকের স্পন্সর ডাইরেক্টর বা মালিক একটা মিটিং ডেকে তাদের বলেছিলাম, আপনারা নিজেদের ব্যাংক থেকে আমানতের ৩০ শতাংশেরও বেশি নিজেরাই নিয়ে গেছেন কেন? এর বেশির ভাগই খেলাপি কেন? তখন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের (বিএবি) তৎকালীন চেয়ারম্যান আমাকে বলেছিলেন, আমরা এত কষ্ট করে, এত ঝামেলা করে, এত জায়গায় এত কিছু দিয়ে, টাকা দিয়ে ব্যাংক করেছি। আমরা নিজেদের টাকা নিজেরা নেব না? এ ছিল তখনকার প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক মালিকদের মানসিকতা। পরে নিয়ম করা হলো, ব্যাংক মালিকরা ওই ব্যাংকের আমানত থেকে ৩ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারবেন না। তখন দেখা গেল তারা ৩ শতাংশও আর নিজের ব্যাংক থেকে নিচ্ছে না। হয়তো অন্য ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে নিচ্ছে।’
আলোচনায় থাকা দুর্বল ব্যাংকের মার্জার বা একীভূতের পদক্ষেপও অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ উপদেষ্টা। অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘দেশে অনেকগুলো দুর্বল ব্যাংক আছে, সেগুলোকে একত্রিত করা যায় কিনা দেখতে হবে। জোর করে করতে গেলে অন্য বেসরকারি ব্যাংক এর দায় নেবে না। সরকারি ব্যাংকের ওপর চড়িয়ে দেয়া হলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতির বোঝাটা সুদহারের যে ফারাক সেটা বেড়ে গিয়ে পুরো অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবেই হোক সাহায্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, সেই ক্ষতি তো সারা দেশকেই কোনো না কোনোভাবে নিতে হয়। আশির দশকে যখন বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল, তখন যে ভুলটা করা হয়েছিল, এখনো সেই ভুল করা হচ্ছে।’
ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘ব্যাংক খাত অর্থনীতির হৃৎপিণ্ডের মতো কাজ করে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। তবে এর আগেও এ রকম রোডম্যাপ ছিল। সেই রোডম্যাপ দিয়ে আমরা কতদূর এলাম, কী কারণে সেখান থেকে বিচ্যুত হলাম, কখন হলাম তার যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। তার যৌক্তিক কারণ না বুঝে আবারো রোডম্যাপ করলে কোনো কাজ হবে না।’
তিনি বলেন, ‘একটি বিষয় লক্ষণীয়, যে ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণের দিক থেকে বড় সেগুলোয় বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে। তার পরও এগুলোয় আমানত কমেনি। তার মানে কোন ব্যাংকে কেলেঙ্কারি হচ্ছে আমানতকারীরা সেটা দেখেন না। একটা অলিখিত নিয়ম দেখেন আমানতকারী যে ব্যাংকে টাকা রেখেছি সরকার আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক আছে তারা রক্ষা করবে। এখন ব্যাংককে রক্ষা করতে হয় কারণ আমাদের মতো দেশে দু-একটা ব্যাংক উঠে গেলে আমানতকারীর বিরাট ক্ষতি হবে ও ব্যাংকের ওপর থেকে আস্থা চলে যাবে। এতে পুরো ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো না কোনোভাবে ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করা হয়। তবে এটা সবসময় টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।’
বর্তমানে বলা হচ্ছে ঋণের ২ শতাংশ পরিশোধ করলেই খেলাপির তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়া হবে। কয়দিন পর তো বলবে টাকা না দিলেও খেলাপি হবে না বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। একই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছেই। খেলাপি ঋণের বিদ্যমান পরিমাণের বাইরে বিরাট অংকের ঋণ রাইট অফ করা হচ্ছে, যেটা ব্যালান্স শিটে অন্তর্ভুক্ত নয়। এতে খেলাপি ঋণ হিসেবে তা প্রকাশ করছে না ব্যাংকগুলো। আবার খেলাপি ঋণ বিভিন্ন মেয়াদে রি-শিডিউল করেছে। এখানেও সে ঋণখেলাপি হিসেবে গণ্য হচ্ছে না। আমদানি-রফতানি নিয়েও তথ্য বিভ্রাট রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মধ্যে। সব দিক বিবেচনায় দেশের ব্যাংক খাত এখন উল্টো রথে।’
নতুন ব্যাংক নিয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, ‘একটা ব্যাংক খোলা হবে আর শহরে কিছু শাখা দিয়ে চলবে, এটার দরকার নেই। তাদের প্রান্তিক পর্যায়ে শাখা খুলতে হবে। একটা সময় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হলে তাদের পরামর্শ দিয়েছি এ খাতের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে। কীভাবে চলতে হবে, তারা আমাদের দেবে। আমরাও তাদের প্রতিবেদন দেব। কিন্তু পরে ব্যাংক খোলার সিদ্ধান্ত এলো রাজনৈতিকভাবে। এতে ব্যাংকে খেলাপি বাড়ছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা স্বচ্ছ না হলে চুরি হবে ব্যাংক খাতে। তাদের অবশ্যই অন্যের কথায় চললে হবে না।’
Related Posts
Bangladesh’s Economic Resilience: A Statistical Snapshot (2024)
Bangladesh’s Economic Ascent: A Journey from 1971 to 2024
Top Foreign Companies Investing in Bangladesh