প্রশ্নঃ আমরা মিডিয়ায় পাশ্চাত্যের সাফল্যের কথা দেখছি। অতএব তা অনুসরণ করতে অসুবিধা কোথায়?
উত্তরঃ আমরা দুইশত বছর ইউরোপিয়ানদের গোলাম ছিলাম। সে কারণেই সাম্রাজ্যবাদী প্রচারমাধ্যম যা ভাবায়, আমরা তা-ই ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, যা খাওয়ায়, যা পরাতে চায় তাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যেন টিভিতে বললে বা পত্রিকায় লিখলেই সব অশুদ্ধ শুদ্ধ হয়ে গেল।
সাম্রাজ্যবাদী প্রচার মাধ্যমগুলো যে কীরকম মিথ্যাচার করতে পারে তার একটি উদাহরণ হলো, গত শতাব্দীর খুব বড় একজন দার্শনিক জ্যঁ পল সার্ত্রে যার দ্বারা ষাটের দশকের তরুণরা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। তিনি মানবতাবাদী দার্শনিক ছিলেন। তার ব্যক্তিত্ব এই মাত্রার ছিল যে, যেখানে নোবেল পুরস্কার পাওয়াটাকে অনেকে এত বড় কিছু মনে করেন, তা পাওয়ার জন্যে সবকিছু, এমনকি নিজেকে বিক্রিও করতে পারেন, সেখানে জ্যঁ পল সার্ত্রে এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। নিজের দর্শনের ওপর এরকমই ছিল তার বিশ্বাস। তাকেই সিআইএ পৃথিবীর একনম্বর সন্ত্রাসী চিহ্নিত করেছিল। অথচ তিনি জীবনে কখনো অস্ত্র ধরেন নি, বোমা ফাটান নি, এমনকি কাউকে কখনো চড়ও মারেন নি।
ষাটের দশকে তার একটি বই আমার হাতে এলো ‘Being in nothingness’ যেটিকে বলা হতো Existentialism এর বাইবেল। অর্থাৎ Existentialism-কে বুঝতে হলে এটিকে বুঝতে হবে। বইটি পড়লাম, কিন্তু বুঝলাম না। পরবর্তী কয়েক বছরে আরো দেড়শর বেশি বই পড়লাম ঐ বইটাকে বোঝার জন্যে। তারপরও কতটা বুঝতে পেরেছি তা আমার নিজের কাছে পরিষ্কার নয়। কেন? কারণ আমি আমার নিজের জ্ঞানের আলোকে তাকে বিচার করতে চাই নি। আমি চেয়েছি, তিনি কী বোঝাতে চাইছেন, তা বুঝতে। মুক্ত মন নিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি এবং তার বক্তব্য বোঝার জন্যে Existentialism-এর ওপর বই সংগ্রহ করে পড়েছি।
পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া সবসময় এটাই হতে দিতে চায় না যে, আপনি মুক্ত মন নিয়ে কিছু শুনতে পারেন, সবসময় একটা preconceived idea আপনার মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
আসলে পাশ্চাত্যের দর্শন বা মিডিয়াকে অবিদ্যা প্রভাবিত ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। যেমন, পাশ্চাত্য দর্শনের ভিত্তি হলো গ্রিক, রোমান সভ্যতা। এই গ্রিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টটল প্রমুখ। এরিস্টটলের সমাজ—চিন্তাটা কী? তার রাষ্ট্রভাবনাটাই এক অবিদ্যা।
প্লেটো ও এরিস্টটলের রাষ্ট্রভাবনায় রয়েছে দুটি শ্রেণীর উপস্থিতি। এক, অভিজাত; দুই, দাস। আর দাসদের অস্তিত্ব হলো অভিজাতদের আরামআয়েশের ব্যবস্থা করার জন্যে। এই দর্শনকে এখনো পড়ানো হয় এবং দর্শনের ভিত্তি বলা হয়। তাদের এই দর্শনকে বোঝাবার জন্যে কার্টুন ইলাস্ট্রেশনে দেখানো হয়েছিল—-একটি পাহাড়, যার চূড়াটা সমতল। সেখানে বসে আছেন আট/ দশজন অভিজাত শ্রেণীর মানুষ। আর পাহাড়ের নিচে আছে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ যারা কোনোরকমে কুঁজো হয়ে পাহাড়ের বোঝাটাকে বহন করে চলেছে। গ্রিক সভ্যতায় যে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, সে গণতন্ত্র হচ্ছে অভিজাত কিছু মানুষের গণতন্ত্র। সাধারণ মানুষের নয়। এটাকে অবিদ্যা ছাড়া আর কী বলা যায়।
রোমান সভ্যতারও একই ব্যাপার। সেখানে গ্লাডিয়েটরদের দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ করানো হতো এবং একজনকে দিয়ে আরেকজনকে হত্যা করানো হতো যা দেখে অভিজাত শ্রেণীর নারীরা পর্যন্ত উল্লসিত হতো।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও আমরা দেখেছি গণতন্ত্রের নমুনা। ভোট বেশি পায় একজন আর প্রেসিডেন্ট হয় আরেকজন। একে গণতন্ত্রের পরিহাস বা অবিদ্যা ছাড়া আর কী বলা যায়?
আবার পাশ্চাত্য বলে, ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’। এই মুক্ত বাজার অর্থনীতির পরিহাস আমরা বুঝতে পারি কবিগুরুর ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি দিয়ে। যেখানে একটি ছত্র আছে, ‘বাবু কহিলেন, বুঝেছ উপেন’—এখানে উপেন হলো দরিদ্র, শোষিতের প্রতীক যার জমিটুকুর জন্যেই তার অশান্তি।
জমিদারবাবু তাকে বোঝালেন—যেহেতু এই জমিটুকুই তার অশান্তির কারণ, অতএব তা দিয়ে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়। সে তা-ই করল। পরবর্তীতে তার নিজের লাগানো আমগাছ থেকে একটি আম ঝড়ে নিচে পড়ল। আর সেই আম কুড়িয়ে খাওয়ার অপরাধে তাকে চোর সাব্যস্ত করা হলো। তখন উপেন বলেছিল, ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে’।
অতএব আমাদের অবস্থা এই উপেনদের চেয়ে বেশি কিছু নয়। আমাদের অবিদ্যার কারণে তারা আমাদেরকে যা বোঝায় আমরা তা-ই বুঝি আমাদের অবিদ্যার কারণে। দরিদ্র হয়ে থাকি যেমন অবিদ্যার কারণে, তেমনি দারিদ্রকে ভাগ্য বলে মনে করি সেটাও অবিদ্যার কারণে।