প্রশ্নঃ বলা হয় জীবন বদলের চাবিকাঠি অটোসাজেশন। এটা কীভাবে সম্ভব? কিছু কথা, কিছু শব্দ, কিছু বাক্য কীভাবে জীবনে এত বড় পরিবর্তন আনতে পারে?
উত্তরঃ অটোসাজেশনে ছোট ছোট কথা, শব্দ বার বার উচ্চারিত হয়ে সৃষ্টি হয় বিশ্বাস ও শক্তির এক অন্ত অনুরণন যা বদলে দেয় সবকিছু। তৈরি করে নতুন বাস্তবতা। বার বার উচ্চারিত ইতিবাচক শব্দ বা কথার প্রভাব সম্পর্কে সাধকরা সচেতন ছিলেন আদিকাল থেকেই। প্রতিটি ধর্মেই ইতিবাচক কথা বা বাণীকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নবীজী (স) বলেছেন, কারো সাথে দেখা হলে সালাম বিনিময়ের পর কুশল জিজ্ঞেস করলে বলবে, ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো আছি’। কেন বলেছিলেন, বললে কী হবে, না বললে কী ক্ষতি, এসব আমরা হাজার বছর ধরেও বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝি নি।
বিশ শতকের শুরুতে মনোবিজ্ঞানীরা এই ‘ভালো আছি’ বলার গুরুত্ব বুঝতে শুরু করলেন। ফরাসী মনোবিজ্ঞানী ডা. এমিল কুয়ে বাস্তব গবেষণায় দেখলেন—ভালো কথা বার বার বললে ভালো জিনিসগুলোই তার দিকে আকৃষ্ট হয়। সে ভালো হতে থাকে। তিনি তার ক্লিনিকে রোগমুক্তির জন্যে প্রয়োগ করলেন অটোসাজেশন। ১৯১০ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত মাইগ্রেন, মাথাব্যথা, বাতব্যথা, এজমা, প্যারালাইসিস, তোতলামি, টিউমার, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, অনিদ্রা থেকে হাজার হাজার মানুষকে ভালো করেছেন এই অটোসাজেশন প্রয়োগ করে। তার এই নিরাময় প্রক্রিয়ায় রোগীকে কিছুদিন সকালে ও বিকেলে একাগ্র মনোযোগ দিয়ে ২০ বার বলতে হতো ‘ডে বাই ডে ইন এভরি ওয়ে আই এম গেটিং বেটার এন্ড বেটার’। ব্যস, রোগ উধাও।
বাংলাদেশে ফলিত মনোবিজ্ঞানের পথিকৃত প্রফেসর এম ইউ আহমেদ নিজের ওপর এই অটোসাজেশন প্রথম প্রয়োগ করেন ১৯৩৪ সালে। প্যারাটাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে চার মাস ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে থাকার পর ডাক্তাররা তার বাঁচার আশা বাদ দিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন। তাকে বজরা নৌকা করে বরিশালে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। বুড়িগঙ্গায় নৌকায় উঠেই তিনি ভেতর থেকে বাঁচার মন্ত্র পেলেন। বার বার বলতে লাগলেন—‘আমি বাঁচতে চাই! আমি বাঁচব!’ তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। একই প্রক্রিয়ায় ১৯৭৩ সালেও ৬৪ বছর বয়সে ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ অবস্থা থেকে বেঁচে ওঠেন তিনি।
প্রফেসর এম ইউ আহমেদ শুধু নিজের ওপরই অটোসাজেশন প্রয়োগ করেন নি; তার প্রবর্তিত মেডিস্টিক সাইকোথেরাপি প্রক্রিয়ায় অটোসাজেশন দিয়ে হাজার হাজার রোগী বিভিন্ন জটিল ব্যাধি থেকে মুক্তি পেয়েছেন বিস্ময়করভাবে। মনোদৈহিক রোগ নিরাময়ে প্রফেসর এম ইউ আহমেদ অত্যন্ত সফলভাবে অটোসাজেশন প্রয়োগ করেন তিন দশক ধরে।
স্বাভাবিকভাবেই আপনার মনে আবারো প্রশ্ন জাগবে অটোসাজেশন অর্থাৎ শুধু কিছু কথা কিছু শব্দ কিছু বাক্য কীভাবে জীবনে এত বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এ রহস্যও বিজ্ঞানীরা আস্তে আস্তে উন্মোচন করেছেন। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা হাজার হাজার গবেষণা করে দেখেছেন, মানুষের নার্ভাস সিস্টেম বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যে কোনো তফাত করতে পারে না। বাস্তব ঘটনা দেখলে যে ব্রেন ওয়েভ সৃষ্টি হয়, সেই একই ঘটনা কল্পনা করলেও একই ব্রেন ওয়েভ সৃষ্টি হয়। যে কারণে সিনেমায় আমরা অভিনয় দেখে হাসি আবার কান্নায় বিষাদে মন ভরে ওঠে। আপনি জানেন পুরোটাই অভিনয়। কিন্তু তারপরও উত্তেজনা বা বিষাদের রেশ কাটাতে সময় লাগে। এই সূত্রকেই মনোবিজ্ঞানীরা কাজে লাগাচ্ছেন কখনো অটোসাজেশনে, কখনো মনছবিতে।
নবীজীর (স) ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো আছি!’ বলতে বলার রহস্য এখানেই। আপনি দিনে ২০/৩০/৪০ জনের সাথে দেখা হওয়ার পর যদি একই কথা বলেন, তাহলে ৪০ বার আপনার মস্তিষ্কে এই ভালো থাকার বাণী যাচ্ছে। বার বার একই বাণী যাওয়ার ফলে মস্তিষ্কে ভালো থাকার তরঙ্গ তৈরি হচ্ছে। ভালো থাকার আকুতি বাড়ছে।
নিউরোসায়েন্টিস্টরা দীর্ঘ পরীক্ষায় দেখেছেন, যখনই মস্তিষ্কে নতুন তথ্য যায়, মস্তিষ্কে নতুন ডেনড্রাইট অর্থাৎ একটি নিউরোন থেকে আরেকটি নিউরোনে নতুন সংযোগ পথ তৈরি হয়। ক্রমাগত একই তথ্য যেতে থাকলে মস্তিষ্কের কর্মকাঠামো (Working Structure) বদলে যায়। মস্তিষ্ক তখন এই নতুন বাস্তবতা সৃষ্টিতে লেগে যায়।
অটোসাজেশনে আপনি আসলে একই কথা, একই বাণী বার বার বলে মন ও মস্তিষ্কের বিশাল শক্তিভান্ডারকে সক্রিয় করে তোলেন। আপনার মনোদৈহিক প্রক্রিয়া নিজের চাওয়াকে পাওয়ার জন্যে প্রস্ত্তত ও যোগ্য করে তোলে। পাওয়ার মনোদৈহিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই চাওয়া পরিণত হয় বাস্তবতায়। অতি দ্রুতই বদলে যায় সব। মনে হয় সব অলৌকিক। নিজেকে মনে হয় ভাগ্যের বরপুত্র।
মূল: প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড
Thank you for your sharing. I am worried that I lack creative ideas. It is your article that makes me full of hope. Thank you. But, I have a question, can you help me?