Business Care News

Business News That Matters

ai generated, Ancient Arabia

প্রশ্নোত্তর সিরিজ – পর্ব ২৫৩: কোনটা বেশি দরকার-দক্ষতা না সততা?

প্রশ্নঃ সফলতার জন্যে সামনে এগুতে হলে কোনটা বেশি দরকার-দক্ষতা না সততা? কখনো মনে হয় দক্ষতা, কখনো মনে হয় সততা। আসলে কী হবে?


উত্তরঃ আসলে বৈষয়িক শক্তির উৎকর্ষের প্রতীক দক্ষতা। আর নৈতিক শক্তির উৎকর্ষের প্রতীক সততা। সাফল্যের জন্যে দক্ষতা এবং সততা দুটোই দরকার। তবে বেশি দরকার সততা। কারণ দক্ষতা সততা সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু সততা দক্ষতা সৃষ্টি করতে পারে।

ব্যক্তিজীবনে যত ধরনের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা বা ডিগ্রি যা-ই থাকুক না কেন, সততা যদি না থাকে তাহলে দক্ষতা কখনো প্রাচুর্য আনতে পারে না। বরং তা সংগ্রহ ও ভোগের স্পৃহা বাড়ায়। সেই সাথে বাড়ায় আসক্তি ও দুর্দশা। কিন্তু দক্ষতার সাথে যখন সততা থাকে তখন তা সেবা ও দানের স্পৃহাকেই বাড়িয়ে দেয়। সততার প্রক্রিয়াই হচ্ছে-এটি দক্ষতা সৃষ্টি করে নিজেকে পরিণত করে অন্যের বিশ্বস্ততার কেন্দ্রবিন্দুতে। একজন মানুষের ভেতর থেকে যখন নৈতিক ও আত্মিক শক্তি জাগ্রত হয় তখন দক্ষতা আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়-পরিস্থিতি তাকে দক্ষ করে তোলে।

এ প্রসঙ্গে আরবদের পারস্য বিজয়ের উদাহরণটি দেয়া যেতে পারে-পারস্য বিজয়ের সময় মহাবীর রুস্তমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে যখন নামিদামি সেনাপতি কাউকেই কাছে পেলেন না, তখন খলিফা ওমর সেনাপতি মনোনীত করলেন সাদ বিন আবু ওয়াক্কাসকে, যার যুদ্ধ পরিচালনায় কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে বিশাল পারস্যবাহিনী হাতি সামনে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সেনাপতি রুস্তম একটা উঁচু জায়গায় হাতির পিঠে হাওদায় বসে দূর থেকে আরব বাহিনীর জীর্ণশীর্ণ অবস্থা দেখে হাসছেন-এ তো কিছুক্ষণের খোরাক!

আবু ওয়াক্কাস বুঝলেন, সরাসরি যুদ্ধে সুবিধা করা যাবে না। তিনি আত্মনিমগ্ন হলেন। বুদ্ধি বেরিয়ে এলো। তীরন্দাজ প্রধানকে নির্দেশ দিলেন- সামনের যে হাতিটাকে অনুসরণ করে দুপাশের হাতিগুলো বল্লমের ফলার মতো এগোচ্ছে-ওটার দুই চোখে তীর মারতে হবে। সবচেয়ে দক্ষ তীরন্দাজ দল অবস্থান নিলো। প্রশিক্ষিত হাতির পাল এগিয়ে আসছে, হাতির পেছনে লাখো সৈন্য। ৫০ হাতের মধ্যে আসার সাথে সাথে দুজন তীরন্দাজ দুটি তীর মারলেন। দুটিই গিয়ে বিঁধলো নেতা হাতির দুচোখে। তীর ঢোকার সাথে সাথে অন্ধ হয়ে হাতি পেছনে ঘুরে গেল। নেতা হাতিকে দিক পরিবর্তন করতে দেখে বাকি হাতিগুলোও পেছনে ঘুরে গেল।

আরব বাহিনীর পরিবর্তে পুরো পারস্য বাহিনী হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। বিপুল সংখ্যক সৈন্য হতাহত হলো। সেনাপতি রুস্তম হাতির হাওদা থেকে নেমে ঘোড়া নিয়ে পালাতে গিয়ে নিহত হলেন। জয়ী হলো আরবরা। অর্থাৎ তাদের সুসজ্জিত বিশাল বাহিনী না থাকলেও নৈতিক শক্তিতে যেহেতু তারা উজ্জীবিত ছিলেন, মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে নতুন রণকৌশল অবলম্বনে অচিরেই তারা দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন এবং বিজয় তারাই পেয়েছেন। অবহেলিত পশ্চাদপদ জনপদের অখ্যাত মানুষরাই তখনকার দুই সুপারপাওয়ার রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। পত্তন করে এক নতুন সভ্যতার।

গত শতাব্দিতে চেয়ারম্যান মাওয়ের নেতৃত্বে লালফৌজও একইভাবে ১৫ বছরের যুদ্ধে চিয়াং কাইশেকের বিশাল সুসজ্জিত বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে চীনে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠা করে। লালফৌজের সেনাপতিসহ সাধারণ সৈনিক-প্রচলিত অর্থে কারোরই কোনো সামরিক ট্রেনিং ছিল না। নৈতিক শক্তিই তাদের মধ্যে চিয়াং কাইশেককে হঠানোর প্রয়োজনীয় দক্ষতা সৃষ্টি করে।

আবার দক্ষতা আছে, কিন্তু সততা নেই-এমন হলে তা কল্যাণ বয়ে আনে না। কারণ সেক্ষেত্রে মানবিকতার দৃষ্টিকোণ লোপ পায় এবং দানবীয় লোলুপ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। যে-কোনো উপায়ে লাভবান হওয়ার বাসনায় সততাকে বিসর্জন দেয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। আমাদের চারপাশে এত অজস্র দুর্নীতি, ভেজাল, প্রতারণা-সবই তো নৈতিকতাবর্জিত দক্ষ লোকদেরই কীর্তি!

শুধু দক্ষতার পরিণাম দুর্দশা-অশান্তি। অনেক কষ্ট করে দক্ষ হলেন-দক্ষ হওয়ার পর আপনার দুর্দশা, অশান্তি আরো বাড়ল। যে-রকম সিএনএন-এর মালিক টেড টার্নার। এত কষ্ট করে সিএনএন করলেন। এখন আর টেড টার্নার মালিক নেই, এখন এর মালিক ‘টাইম ওয়ার্নার কোম্পানি’। এর মধ্যে খবরে দেখলাম, আমেরিকাতে নাকি এক মাসে এত বেশি সংখ্যক সিইও পদত্যাগ করেছে, যা এর আগে কখনো করে নি। কেন? কারণ নানারকম ম্যানিপুলেশন আর দুর্নীতির অভিযোগ।

আমেরিকার বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দার জন্যে দায়ী করা হচ্ছে হার্ভার্ডের এমবিএ করা দক্ষ ম্যানেজারদের। ইউরোপের বড় বড় ব্যাংকে লালবাতি জ্বালানোর পেছনেও কাজ করেছে এই দক্ষ সিইওদের দুর্নীতি। অর্থাৎ শুধু দক্ষতা লোভ, আসক্তি আর অনৈতিকতার প্রসার ঘটায় যা পরিণামে শুধু সেই ব্যক্তির নয়, গোটা সমাজেই ডেকে আনে দুর্দশা, অশান্তি।

যুক্তরাষ্ট্র এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ শিল্পোন্নত দেশ। বিশ্বের ৫৫% সম্পদ তার অধিকারে। কিন্তু মার্কিন সরকার এখনো এটা বলতে পারে না যে, দেশে সাহায্য নেয়ার মতো কোনো লোক নেই, বস্তিতে রাস্তার পাশে কেউ রাত কাটায় না, না খেয়ে কেউ থাকে না। বলতে পারে না, একজন নারী ধর্ষণের আশঙ্কা ছাড়াই দিনে বা রাতে নিউইয়র্ক শহরের যে-কোনো রাস্তায় চলাচল করতে পারে। ২০১১ সালে নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ বা ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’ আন্দোলনে প্রকাশ পেয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বঞ্চিত মানুষের করুণ অবস্থা। নেতাহীন এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল-সবচেয়ে ধনী মাত্র ১% মানুষের হাতে যে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে, তা সুষম বণ্টন করে দিতে হবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার বাকি ৯৯% মানুষের মাঝে।

আবার ইতিহাসের দিকে তাকান। এখন থেকে ১৪০০ বছর আগে খোলাফায়ে রাশেদার যুগের শেষ দুই দশকে আরবে দান বা যাকাত নেয়ার মতো কেউ ছিল না। আরবের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে একজন নারী একা চলে যেতে পেরেছেন, পথে কোনো বিপদের আশঙ্কা ছাড়াই। এটাই হচ্ছে সততা এবং দক্ষতার মধ্যে পার্থক্য।

১৪০০ বছর আগে আরবে যে মানুষগুলো সবসময় লিপ্ত থাকত হানাহানি লুটপাটে, কন্যাশিশুকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা ছিল যাদের সামাজিক ঐতিহ্য, সেই মানুষগুলোই রূপান্তরিত হয়েছিল মানবিকতার প্রতীকে। এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল নৈতিক শক্তির উত্থানের ফলে।

আসলে প্রতিটি মানবশিশুই ভালো মানুষরূপে জন্মগ্রহণ করে। সাধারণত খারাপ পারিপার্শ্বিকতার কারণে ভালো গুণ চাপা পড়ে খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। কিন্তু যে অন্তরে ডুব দিতে পারে, পারিপার্শ্বিকতা যত খারাপই হোক না কেন-তার ভেতরের নৈতিক শক্তি বিকশিত হবেই। আর নৈতিক শক্তির অন্তর্জাগরণ তাকে সব বিষয়েই পর্যায়ক্রমে দক্ষ করে তুলবে। সে অর্জন করবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য।

মূল: প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড

Skip to content