প্রশ্নঃ বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশ বলে পরিচিত হলেও এক শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রা এতই বিলাসবহুল যে, এ বক্তব্য বিশ্বাস করা শক্ত। আমার এক আত্মীয় আছে। পাঁচতারা হোটেলে বন্ধুদের নিয়ে নিয়মিত বুফে ডিনারে মাথাপিছু তার যে ব্যয় হয় তা দিয়ে অনায়াসে একটি ১০ সদস্যের পরিবারের সারা মাসের খাওয়া খরচ মিটে যাবে। এ বিলাসিতা কতটা গ্রহণযোগ্য?
উত্তরঃ দুর্দশার একটি প্রধান কারণই হচ্ছে এ অপব্যয় বা অপচয় প্রবণতা। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বুঝি না যে, যেটাকে আমরা ব্যয় মনে করছি, তা আসলে অপব্যয়। ব্যক্তিগতভাবে যেমন এটি সত্যি, জাতিগতভাবেও তা সত্যি। যেমন বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও বিদ্যুৎ ব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয় নি। কারণ এ টাকাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যয় করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে, অপ্রয়োজনীয় খাতে। যেমন কোথাও হয়তো বৈদ্যুতিক খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে কিন্তু সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো ব্যবস্থা করা হয় নি। আবার কোথাও হয়তো ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে কিন্তু যথাযথ ট্রান্সমিশন লাইন তৈরি হয় নি।
শিক্ষাখাতেও একই অবস্থা। অনুদান বা সরকারি সাহায্যে বিশাল এবং ব্যয়বহুল সব স্কুল বা কলেজ বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে পড়ানোর কোনো শিক্ষক নেই। ফলে তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে বা বাসাবাড়ি হিসেবে দখল হয়ে আছে এসব ব্যয়বহুল ভবনগুলো।
আমাদের দেশে অপচয় প্রবণতা সম্ভবত অবিশ্বাস্যরকম বেশি। যে কারণে এদেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অবিশ্বাস্যরকমভাবে বাড়ছে। আমাদের দেশের একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জমান কোয়ান্টাম মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠানে এসে বলছিলেন, সরকারি হিসেবে ১৯৯১-৯২-এ ধনীর আয় ছিলো দরিদ্রের আয়ের ১৮ গুণ বেশি, ৯৫-৯৬-এ এটা হয় ২৭ গুণ বেশি, ২০০০ সালে হয় ৪৬ গুণ বেশি এবং ২০০৫ সালে ৮৪ গুণ বেশি। অর্থাৎ মাত্র ১৫ বছরে ১৮ গুণ থেকে ৮৪ গুণে রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ যার কম আছে তার আয় আরো কমছে, যার বেশি আছে, তার আয় আরো বাড়ছে। এটাই হলো অপচয়ের পরিণতি।
আসলে যে জাতি অপচয়ে এবং বিলাস-ব্যসনে লিপ্ত হয়েছে, তারাই একসময় হতদরিদ্র এবং অসহায় অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। ইতিহাসে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে।
মুঘল বাদশাহদের বিলাসিতার কথা সর্বজনবিদিত। সে সময়কারই একজন নবাবের বাবুর্চি নিয়োগ করা হবে। নতুন বাবুর্চি হিসেবে যাকে নিয়োগ দেয়া হলো সে এসে প্রথম যে কাজটি করলো তা হলো, রান্নাঘর থেকে ১০ মণ ঘি নর্দমায় ফেলে দিলো।
সবাই তো ভীষণ অবাক, ক্ষুব্ধ। নালিশ গেল নবাবের কাছে। নবাব শুনে ক্রুদ্ধ হলেন না, তার শাস্তির ব্যবস্থা করলেন না। তিনি শুধু বললেন, ঠিক আছে, আরো ১০ মণ ঘি তাকে পাঠিয়ে দাও।
বাবুর্চি তখন বললো, হাঁ, এ নবাবের চাকরি আমি করবো। কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্বাল দিয়ে ঘন করে ঘি-এর নির্যাস দিয়ে যে আমি রান্না করবো তা সরবরাহ করার সামর্থ্য এ নবাবের আছে। আর এটা পরীক্ষা করার জন্যেই আমি নর্দমায় ঘি ফেলে দিয়েছি। এতে যদি তিনি ক্রুদ্ধ হতেন, তাহলে বুঝতাম আমি আমার পছন্দমতো বিলাস-ব্যসনে রান্না করতে পারবো না। সেক্ষেত্রে তার বাবুর্চির চাকরি করাও আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। অর্থাৎ এ নবাবদের বাবুর্চিও কতটা বিলাসী ছিলো।
এই রাজা-বাদশাদের পরিণতিও কিন্তু খুব করুণ। ৭০-এর দশকে ভারতের দিল্লি এবং কলকাতায় শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের দুজন অধস্তন পুরুষকে পাওয়া গেল। একজন ধোপার কাজ করে, আরেকজন টানা রিকশা চালায়। অথচ যে জাতি বা যে দেশগুলো এখন বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে এই একটি ক্ষেত্রে তারা সবসময় সচেতন-হিসেব সচেতনতা এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় থেকে বিরত থাকা। আর যারা সেটি পারে নি সেসব বিশাল বিশাল জনপদের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করে তাদেরকে পরিচালিত করছে এসব ক্ষুদ্র জনসমষ্টির দেশ বা জাতিগুলো।
তাই ব্যক্তিগতভাবে বা জাতিগতভাবে যতক্ষণ না এ অপচয়গুলোকে শনাক্ত করে তা থেকে মুক্ত হওয়া যাবে, ততক্ষণ ব্যক্তি এবং জাতির জীবনে সমৃদ্ধি আসবে না, প্রশান্তি আসবে না।
তথ্যসূত্রঃ প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড
Related Posts
Q&A Series – Episode 292: Failure is the pillar of success!
Q&A Series – Episode 291: What exactly is visualization?
Q&A Series – Episode 290: How does visualization work?