Business Care News

Business News That Matters

school going children using smartphone while lying on the sofa

Photo by cottonbro studio on Pexels.com

প্রশ্নোত্তর সিরিজ – পর্ব ১৮৫: স্কুলগামী সন্তানকে মোবাইল দেয়া!

প্রশ্নঃ আমার মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে। তাকে মোবাইল কিনে দেবার জন্যে সে বাসায় অশান্তি করছে। আমরা তাকে মোবাইল দিতে চাচ্ছি না আবার ম্যানেজও করতে পারছি না। এখন কী করব?


উত্তরঃ এখানে আপনাকে দৃঢ় হতে হবে, কিন্তু রূঢ় নয়। বুঝিয়ে বলতে হবে যে, “মা, স্মার্টফোন ব্যবহারের বয়স এখনো তোমার হয় নি। বয়স হোক, তারপর আমরাই তোমাকে দেব।” আসলে ১৮ বছর বয়সের আগে একটি শিশু বা কিশোরের হাতে যখন স্মার্টফোন আসে তখন এর উপকারের চেয়ে ক্ষতির দিকগুলোই তাকে প্রভাবিত করে বেশি। কারণ ১৮ বছরের আগে সাধারণভাবে একটি ছেলে বা মেয়ে ভালো-মন্দের পরিণাম সেভাবে বুঝতে পারে না। সাময়িক চাকচিক্যের প্রতি এ বয়সের যে সহজাত আকর্ষণ, সেটা থেকেও নিজেকে বাঁচানো তার জন্যে হয় কঠিন।

এ নিয়ে আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস- শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে যাদের কাজ, তাদের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ কিছু তথ্য। একটা জরিপকে উদ্ধৃত করে তারা বলে, শতকরা ৭৫ ভাগ টিনএজারের কাছে এখন স্মার্টফোন আছে। আর এটাকে সোশাল মিডিয়ার কাজে ব্যবহার করছে শতকরা ২৫ জন। শতকরা ৫৪ জন ব্যবহার করছে টেক্সট করবার জন্যে আর ২৪ জন ব্যবহার করছে ইন্সট্যান্ট ম্যাসেজিংয়ের জন্যে। তো টিনএজারদের ২২%-ই দিনে ১০ বারেরও বেশি ঢুকছে তাদের পছন্দের সোশাল মিডিয়া সাইটে। আর দিনে একবার তো বটেই, একের বেশিবারও ঢুকছে এদের অর্ধেকেরও বেশি। তার মানে এই কিশোর-তরুণদের সামাজিক এবং আবেগিক বিকাশের প্রায় পুরোটাই ঘটছে ইন্টারনেট এবং সেলফোনে বসে। ফেসবুকসহ সোশাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাবগুলোর মুখে পড়ছে প্রতিনিয়ত।

বৃটেনে কর্মরত একজন চিকিৎসক রঙ্গন চ্যাটার্জী বলেন, কিশোরকিশোরীদের মানসিক সমস্যা এবং তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের যে সম্পর্ক আছে, তার অনেক প্রমাণ আছে। একবার ১৬ বছরের একটি কিশোরকে রোগী হিসেবে পেয়েছিলাম যে নিজের হাত-পা কেটে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছিল। প্রথমে ভাবলাম, তাকে বিষণ্নতা-রোধী ওষুধ দেবো। কিন্তু তার সাথে কথা বলার পর বুঝলাম, সোশাল মিডিয়ার কারণেই তার এ জটিলতা।

শুধু তাই না, স্মার্টফোনের অতিব্যবহারের কারণে এখন তারা ভুলতে বসেছে তাদের মস্তিষ্কের ব্যবহার। একটা ঘটনা বলি-২০১৭ সালে যখন ইংল্যান্ডে গেলাম, একদিন একটা দোকানে গেছি কিছু কিনতে। তো এর মধ্যেই সেখানে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন একজন ক্রেতা। বেশকিছু কেনাকাটা করলেন। তো গোল বাঁধল পেমেন্ট করতে গিয়ে। কারণ প্রায় চার হাজার পাউন্ডের পেমেন্ট তিনি করতে চাচ্ছেন ক্যাশে। তাও খুচরো সব নোট দিয়ে- ১০ পাউন্ড, ২০ পাউন্ড ইত্যাদি।

এদিকে আপনারা তো জানেন যে, পাশ্চাত্যে এখন পেপার ক্যাশের চল প্রায় উঠেই গেছে! প্রথমে কাউন্টারম্যানরা নিতেই চাচ্ছে না। নানানভাবে অনুরোধ করছে ক্রেডিট কার্ড বা অন্য কোনোভাবে তিনি পেমেন্টটা করতে পারেন কিনা। যখন তারা নিশ্চিত হলো যে, ক্যাশই নিতে হবে, তখন শুরু হলো আসল ঝামেলা। ক্যাশ কাউন্ট করতে পারছে না। প্রথমে কাউন্টারম্যান শুরু করল গোনা। পারল না। এরপর এলেন সুপারভাইজার। তিনিও পারলেন না। শেষমেশ ম্যানেজার। তিনজনে মিলে বহুকষ্টে অবশেষে গোনা শেষ করল। ততক্ষণে গায়ের কালঘাম ছুটে গেছে তাদের। আর চরম বিরক্ত কাস্টমারের ওপর। এতগুলো নোট কেন দিল সে! তো এই হচ্ছে পাশ্চাত্যের মানুষদের অবস্থা! প্রযুক্তিনির্ভর হতে হতে মস্তিষ্ককে বানিয়ে ফেলেছে তারা ভোঁতা।

এতো গেল পাশ্চাত্যের কথা। বাংলাদেশে কী অবস্থা? বাংলাদেশ টেলি যোগাযোগ কর্তৃপক্ষ বিটিআরসি-র ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রায় ৩.৫% নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে। আর এ শিশুদের একটা বড় অংশই যুক্ত নানা ধরনের সোশাল মিডিয়া সাইটের সঙ্গে। ঢাকা নাকি ফেসবুক ব্যবহারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শহর। আর বলা হয়, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ৯০% এরই বয়স ১৮ থেকে ২৯!

এর মধ্যে পত্রিকায় দেখলাম, স্মার্টফোনের কারণে নাকি বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে! বিয়েতে রাজী না হওয়ায় নাকি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এটাও স্মার্টফোনের কুফলেরই একটি। প্রথমে যোগাযোগ করছে, আসক্তি সৃষ্টি হচ্ছে। এরপর যখন বিয়ের কথা উঠছে, তখন আর রাজী হচ্ছে না। ফলে এই দ্বন্দ্ব এবং তা থেকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো দুঃসাহসীও হচ্ছে এই কিশোরবয়সীরা। এজন্যেই কার সাথে যোগাযোগ করছি, কতটুকু যোগাযোগ করছি, সেটা বুঝতে হবে। যে বয়স পর্যন্ত সন্তান এটা না বোঝে, সে পর্যন্ত তার যোগাযোগ করার সুযোগগুলো সীমিত রাখতে হবে।

তাই আপনার মেয়েকে মমতা দিয়ে বোঝান। তাকে কোয়ান্টাম থেকে প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখান। বুলেটিনটা হাতে দিয়ে বলুন, পড়ে দেখ, তোমাকে মোবাইল দিলে তোমার কী কী ক্ষতি হবে। অর্থাৎ তাকে বোঝাবার চেষ্টা করুন। কিন্তু তার জেদের কাছে আত্মসমপর্ণ করবেন না। কারণ আজকে সন্তান মোবাইল ফোন পাওয়ার জন্যে অশান্তি করছে। মা-বাবা হিসেবে এটুকু আপনাকে সহ্য করতে হবে। কারণ নিজের ‘পাগল’কে তো আর ছেড়ে দিতে পারবেন না। কিন্তু এই অশান্তি এড়াতে যদি মোবাইল কিনে দেন, তাহলে ভবিষ্যতে অশান্তির পরিমাণ আরো বাড়বে। সন্তান তখন আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং পরিণামে আপনিই পস্তাবেন বেশি।

আর মা-বাবা হিসেবে আপনাদের জীবনধারাতেও পরিবর্তন আনতে হবে। ঘরে যখন থাকবেন, ঘরকে সময় দেবেন। বাসায় ঢুকেই টিভি, ল্যাপটপ, মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন না। কেউ টুইটার, কেউ ফেসবুক, কেউ স্ন্যাপচ্যাট নিয়ে একেকজন একেকদিকে থাকবেন না। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা আলাপ-আলোচনা ও গল্প করুন। রাতে একসাথে খান। আহাম্মকের বাক্সের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না।

আর রাত এগারোটার পরে টিভি, কম্পিউটার ও মোবাইলসহ ভার্চুয়াল সব সবকিছু অফ করে দিন। ছেলেমেয়ে যদি পড়ার কথা বলে, রাত জেগে কম্পিউটারে কাজ করার কথা বলে, তাকে সকালের কথা বলুন। বলুন যে, সকালে উঠে পড়তে বা কাজ করতে। বলুন যে, সারারাত তুমি তোমার রুমে জেগে থাকবে আর সারা সকাল ঘুমাবে, দুপুর ১২টায় উঠে ব্রাঞ্চ (ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ একসাথে) করবে, তা তো হবে না। রাতে যেহেতু আমি ঘুমিয়ে থাকব, তুমি সারারাত কী করছ, আমি তো সেটা দেখব না। তাই তোমাকেও ঘুমাতে হবে।

কারণ গভীর রাতে সে যে সাইটগুলোতে যাবে বা দেখবে, সকালে উঠে সে সাইটগুলোতে ঢুকে সে আর সেই আনন্দ পাবে না। কারণ কিছু কিছু কাজ আসলে কিছু বিশেষ সময়ে করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সময় পাল্টে গেলে সেই কাজটাই আর করার আগ্রহ হয় না।

যদি সন্তান তারপরও জোর করে, তখন আপনিও তার সাথে বসে থাকেন। বলেন, ঠিক আছে, আমিও তাহলে তোমার সাথে জাগি। তুমি একা একা রাত জাগবে, আমি তোমার মা হয়ে ঘুমাব, তা কি করে হয়? ছোটবেলায় কি তা হয়েছে? বরং তুমি ঘুমিয়েছ, আমি জেগে ছিলাম। যাতে তোমার ঘুমটা ডিসটার্ব না হয়। কখন তুমি ঘুম থেকে কেঁদে ওঠ আর তোমাকে দুধ খাওয়াতে হয়। দেখবেন যে, সন্তান তখন আর কিছু বলতে পারছে না!

অর্থাৎ কৌশল বুঝতে হবে। আপনাকে সন্তানের সাথে বুদ্ধির ফাইট করতে হবে; মারামারি নয়। সে যেভাবে আপনাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করছে, আপনিও তাকে সেভাবে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করবেন। কিন্তু তার ভয়টাকে ভাঙিয়ে দেবেন না। ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কাছে আত্মসমপর্ণ করে ফেলবেন না। অনেক মা-বাবা সন্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলেন। সন্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করার কিছু নেই। যারা করেছে কোনো লাভ হয় নি। বরং পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে।

হাঁ, তবে সন্তান যদি বুদ্ধিমান হয়। আপনার চেয়ে জ্ঞানী হয়। সন্তানকে স্যালুট করবেন। বলবেন, বাবা, এখন দেখছি তোমার জ্ঞান আমার চেয়ে বেশি, আমি তোমাকে আগে সালাম দেব। কিন্তু তোমার নির্বুদ্ধিতার কাছে আত্মসমর্পণ করব না।

অর্থাৎ সন্তানের সাথে দুর্ব্যবহার বা রাগারাগি নয়। গামা লেভেল নয়, আলফা লেভেল। কারণ সে বুঝতে পারছে না বলেই তো অশান্তি করছে। যখন বুঝবে তখন আর করবে না। অর্থাৎ সন্তানের প্রতি মমতা থাকবে। কিন্তু নিজের নৈতিক বক্তব্যের ক্ষেত্রে দৃঢ় হতে হবে। যদি দৃঢ় না হতে পারেন, এই ছেলেমেয়ে আপনার থাকবে না। আজকেও থাকবে না, কালকেও থাকবে না।

তথ্যসূত্রঃ প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড

Skip to content