Business Care News

Business News That Matters

Facebook, trap, waste time

ভার্চুয়াল ভাইরাস

প্রশ্নোত্তর সিরিজ – পর্ব ৬৪ঃ ফেসবুক : সময় অপচয়ের নতুন ফাঁদ

প্রশ্নঃ যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের অনেকেই ফেসবুক নিয়ে মেতে থাকেন। ফেসবুক বা ইন্টারনেট ব্যবহারের কোনো ক্ষতিকর দিক আছে কি?


উত্তরঃ আসলে এই ফেসবুক হচ্ছে একটা ফেসলেস বুক। এবং এটাতে যদি বেশি মেতে থাকেন তো আপনার ফেস বলে আর কিছু থাকবে না। মানে এর চেয়ে সময়ের অপচয় আর কিছু নেই। আসলে ফেসবুক নিয়ে সম্প্রতি সমাজবিজ্ঞানীরা নানা ধরনের গবেষণা পরিচালনা করছেন। তারা দেখছেন—আধুনিক মানুষের অস্থিরতার একটা বড় কারণ হলো ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট—এগুলোর তৎপরতা।

ফেসবুকসহ আরো যেসব সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট আছে—টুইটার, গুগল প্লাস, লিংকড-ইন—সবগুলোরই সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো—আসক্তি। ধরুন, আপনি ফেসবুকে অন্তর্ভুক্ত হলেন। আপনি কী করবেন? প্রতিদিন নিয়ম করে আপনার বন্ধুদের আপডেটেড স্ট্যাটাস পড়তে শুরু করবেন। তারপর আপনি দেখবেন এখানে স্কুল-কলেজের পুরনো বন্ধু-বান্ধবীদের অনেককেই পেয়ে গেছেন। তাদের ছবি দেখছেন। আপনি তখন আপনার ছবিও দিতে চাইবেন—আপনার নিজের ছবি, বাড়ির ছবি, পোষা কুকুরের ছবি-সবকিছুই।

এখানেই শেষ নয়। আপনি চাইবেন এ ছবিগুলোতে আপনার বন্ধুরা প্রতিদিন কমেন্ট পাঠাক। আপনিও তাদের সবকিছুতে কমেন্ট পাঠাতে থাকবেন। আর ফেসবুকের সবচেয়ে আসক্তিকর দিক হলো এর গেমসগুলো। কাজ বাদ দিয়ে বা পরিবারের সাথে সময় না কাটিয়ে গেমসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যেভাবে আমরা সময় নষ্ট করি তাতে এটাকে আসক্তি বললেও কম বলা হয়।

আর ফেসবুকের আরেকটি ক্ষতিকর প্রবণতা হলো—এখানে আপনার সবকিছুই উন্মুক্ত। একবার আপনি যখন ফেসবুকে সাইনআপ করছেন, আপনি পৃথিবীর কাছে নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরছেন। আপনার সম্পর্কে যে কেউ যে-কোনো ধরনের তথ্য জানতে চাইলে সে তা পেয়ে যাবে ফেসবুকে। আর এটা ব্যবহার করে আপনাকে ভয় দেখানো থেকে শুরু করে আপনাকে যে-কোনো স্বার্থের জন্যে ব্যবহার—সবকিছুই সে করতে পারবে।

ফেসবুকে ইউজাররা নিজেদের সম্পর্কে এত ব্যাপক তথ্যাদি দেন যে, চাইলে যে-কোনো ব্যক্তি এই তথ্যগুলোকে কাজে লাগিয়ে তাকে হেনস্থা করতে পারে। যেমন, আপনি হয়তো কোনো চাকরির জন্যে আবেদন করেছেন। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যদি চায় তাহলে আপনার এমন অনেক তথ্য ফেসবুক থেকে নিতে পারে যা আপনি তাদের জানাতে পছন্দ করতেন না বা জানানোটা আপনার ঐ প্রতিষ্ঠানে ঢোকার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে সাধারণ ইউজাররা কিন্তু নিজের অজান্তেই তুলে দিচ্ছেন নিজের সম্পর্কে এসব তথ্য যা ব্যবহৃত হচ্ছে তার নিজেরই বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে নিউজউইকের জুন, ৭ সংখ্যায় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ‘দি হাই প্রাইস অফ ফেসবুক’ নামে, যাতে বলা হয়েছে—পাশ্চাত্যে আধুনিক ‘টেকি জেনারেশন’-এর একটা গ্রুপ এখন ফেসবুককে বর্জনের আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন যাকে তারা বলছেন মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গের এক জঘন্য আক্রমণ।

ফেসবুক নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকের ৯ জুন, ২০১০ সংখ্যায়। পাঠকের সুবিধার্থে সে প্রতিবেদনের সংক্ষেপিত অংশটি এখানে দেয়া হলো-

ফেসবুক : সময় অপচয়ের নতুন ফাঁদ

বিশ্বের ৪০ কোটিরও বেশি লোক ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছে। এদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ কোটি প্রতিদিন ফেসবুকে ঢোকে। এদের প্রত্যেকের গড়ে ১৩০ জন করে ‘বন্ধু’ আছে। মাসে ফেসবুকের সব ব্যবহারকারী মিলে এর পেছনে ৫০ হাজার কোটি মিনিট সময় ব্যয় করে—এ কথাগুলো বহুল আলোচিত সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ‘ফেসবুক’ নিজেই সদর্পে লিখে রেখেছে তার পরিসংখ্যান পাতায়।

এই বিপুল সময়কে ঘণ্টা দিন বছর—এভাবে হিসেব করলে হয় ৯ লাখ ৫১ হাজার ২৯৩ বছর। অর্থাৎ বিশাল জনগোষ্ঠীর এক মাসের মোট সময় থেকে সাড়ে নয় লাখ বছর নিজের পেছনে খরচ করাতে পারা ফেসবুকের কাছে দারুণ গর্বের বিষয়। কিন্তু যারা সেই সময়টা ফেসবুককে ‘উৎসর্গ’ করছে তারা কী পাচ্ছে সেটা জানার জন্যে ‘ফেসবুক’ আসলে কী সে সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা দরকার। আর মা-বাবাদের জানা উচিত তাদের সন্তানরা ফেসবুকে বুঁদ হয়ে আসলেই কতটা ‘সামাজিক’ হয়ে বেড়ে উঠছে।

পৃথিবীর কোটি কোটি ওয়েবসাইটের একটি হচ্ছে এই ফেসবুক ডটকম। ফেসবুকে একাউন্ট খুলে সেখানে আপনার পরিচয় লিখতে পারেন, ব্যক্তিগত ছবি রাখতে পারেন। আপনার বর্তমান অবস্থা, অবস্থান ইত্যাদি লিখে রাখতে পারেন। অন্যরা আপনাকে ‘বন্ধু’ হিসেবে তাদের একাউন্টে যোগ করলে আপনার একাউন্টে যা লিখে রেখেছেন কিংবা যেসব ছবি সেখানে দিয়ে রেখেছেন সেগুলো সবাই দেখতে পাবে।

আপনি অন্যদের প্রোফাইলে ঢুকে তারা যে মন্তব্য লিখে রেখেছেন কিংবা যেসব ছবি দিয়ে রেখেছেন তার প্রেক্ষিতে মন্তব্য লিখতে পারেন। এভাবে মন্তব্য কিংবা পাল্টা-মন্তব্য চালিয়ে যেতে পারেন। মোটামুটি এই হলো ফেসবুক এবং এর ‘সামাজিক যোগাযোগ’।

তরুণ প্রজন্ম ফেসবুকের মাধ্যমে কী ধরনের সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করছে সেটা পর্যবেক্ষণের জন্যে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন এমন ১০ জন তরুণের প্রোফাইল বেছে নিয়ে তা ফলো করা হয়। কমেন্ট লেখার সময় বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এদের মধ্যে কেউ কেউ রাত ১১টা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত এ ওয়েবসাইটের পেছনে সময় ব্যয় করেছে!

তাদের ‘একটিভিটি’ লিস্ট থেকে দেখা যায়, সবাই এ সময়টুকু বিভিন্ন মেয়ের প্রোফাইলে মন্তব্য লিখে সময় কাটিয়েছে। আবার কেউ কেউ অন্যের ছবির এলবামে ঢুকে সেখানে অশ্লীল মন্তব্য লিখেছে! এভাবে দিনের কিংবা রাতের মূল্যবান সময় খরচ করে ‘সামাজিক যোগাযোগ’ রক্ষা করছে তরুণ প্রজন্ম!

আমাদের দেশে ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছে প্রায় ৮ লাখ ৭৬ হাজার জন। এর মধ্যে পুরুষ ছয় লাখ ৪৩ হাজার আর মহিলা দুই লাখ ৩৩ হাজার। এদের মধ্যে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ আট হাজার। অর্থাৎ মোট ব্যবহারকারীর অধিকাংশই এমন বয়সের, যে বয়সের মূল ব্রত হওয়া উচিত শিক্ষালাভ কিংবা ক্যারিয়ার গঠনে মনোনিবেশ। আর তারাই রাত জেগে এই ‘সামাজিক যোগাযোগ’ রক্ষা করে চলেছে!

যারা পড়াশোনা শেষ করে চাকরি জীবনে প্রবেশ করেছেন বলে ধরে নেয়া যায় (২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী) তাদের মধ্যে ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছেন মাত্র ৫৩ হাজার। ৩৫ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারী আছেন সাত হাজারের মতো। অর্থাৎ, যে বয়সী লোকদের প্রচুর অবসর, যাদের পুরনো বন্ধুবান্ধব কিংবা আত্মীয়স্বজনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার কথা, ফেসবুকের প্রতি তাদের আগ্রহ সামান্যই। ফেসবুক টিকে আছে অল্পবয়সী ছাত্রছাত্রীদের মূল্যবান সময় গলাধঃকরণ করে।

ফেসবুকে একজন পুরুষের গড়ে আড়াইশ ‘বন্ধু’ আছে। আর একটি মেয়ের গড়ে এক হাজার ‘বন্ধু’! কোনো কোনো মেয়ের ‘বন্ধু’সংখ্যা পাঁচ হাজার! পুরুষের বন্ধু তালিকায় যারা থাকে তার অল্প কয়েকজন তার চেনাজানা পুরুষ বা নারী বন্ধু আর বাকিরা হয় অপরিচিত নারী বা নারীর ছদ্মবেশী পুরুষ। তরুণরা ফেসবুকে ঢুকে বেশিরভাগ সময় ব্যয় করে নারী ব্যবহারকারীদের মনোযোগ আকর্ষণে।

বাসা কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বসে অনেক ছাত্রছাত্রী ও অফিসে বসে অনেক কর্মচারী ফেসবুকে সময় ব্যয় করেন। যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন জার্মানি ইটালিসহ উন্নত দেশগুলোর অধিকাংশ নামকরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেসবুক ব্লক করা।

যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ করপোরেট অফিসে ফেসবুক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ হার ব্রিটেনে প্রায় ৭০ শতাংশ এবং অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ৫৫ শতাংশ। ফ্রান্স স্পেন ইটালি জার্মানি জাপানসহ বহু দেশের অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে ফেসবুক বন্ধ করে রাখা হয়। অনেক অফিসে এর ব্যবহার ‘চাকরি ছাঁটাইযোগ্য অপরাধ’ হিসেবে নিয়োগপত্রে শর্ত থাকে।

ফেসবুক ব্যবহারকারীরা বসে বসে বন্ধু খোঁজা এবং প্রোফাইলে মন্তব্য লেখাকে সামাজিকতা মনে করেন। আর এভাবে আপনি যত বেশি ‘সামাজিক’ হবেন ফেসবুকের ব্যাংক একাউন্টে তত টাকা জমা হবে। ফেসবুক ওয়েবসাইটে ঢুকে যতবার যে-কোনো লিংকে ক্লিক করবেন ততবার নতুন করে বিজ্ঞাপন লোড হবে। একবার লোড হলে তাকে এক ইম্প্রেশন বলে। প্রতি এক হাজার ইম্প্রেশনের জন্য ওই বিজ্ঞাপনদাতা থেকে ফেসবুক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকে।

এই ব্যবসায়ে মূলধন হচ্ছে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মতো ‘সামাজিক’ মানুষের অপচয় করা সময়। যারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারছেন না তাদের ব্যবহার করে কীভাবে কোটি কোটি ডলার আয় করছে ফেসবুকের কর্ণধারেরা। ২০০৯ সালে ফেসবুকের আয় ছিলো ৫৫০ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১০ সালে এর আয় এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছে তারা। একজন ব্যবহারকারীর মাধ্যমে সিপিএম এ্যাড থেকে দুই ডলার আয়ের টার্গেট থাকে ফেসবুকের।

প্রতিটি প্রযুক্তির প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ নির্ভর করে এর ব্যবহারকারীর ওপর। তেমনি ফেসবুকও। এখানে একটি মন্তব্য লিখে আপনি সবাইকে জানিয়ে দিতে পারেন আপনার অবস্থা কিংবা অবস্থান। সেলিব্রেটিরা তাদের ভক্তদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ রাখতে পারে ক্লায়েন্টদের সাথে। গ্রুপ করে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে পরস্পরের সাথে। নিজের অনুভূতি বিনিময় করতে পারেন বন্ধুদের সাথে।

ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অজুহাত—এখানে ছেলেবেলার বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া যায়। তা-ই যদি হয় তাহলে স্কুল বা কলেজে যাদের সঙ্গে পড়েছেন তাদের খুঁজে বের করা কি জীবনের সবচেয়ে বড় ব্রত?

পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের মূল্যবান সময় নষ্ট করে, পারিবারিক জীবনে অশান্তি ডেকে এনে দিনের পর দিন চলছে এ সামাজিক যোগাযোগ। একজন মানুষ দৈনিক তিন/ চার ঘণ্টা এই যোগাযোগে ব্যয় করছে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খুঁজতে। সবার প্রোফাইলে ঢুকে ‘কমেন্ট’ লেখার এ সামাজিকতায় নিজের অলক্ষ্যে জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অতি মূল্যবান সময়।

তথ্যসূত্রঃ প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড

Skip to content