প্রশ্নঃ এখন বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোতে পড়ালেখার মান ভালো নয়। বাচ্চাকে কোন স্কুলে পড়াব? বাচ্চাদের কার্টুন দেখা কীভাবে বাদ দেবো?
উত্তরঃ শুধু পড়ালেখার মান দেখেই সন্তানের জন্যে স্কুল বাছাইয়ের এই সিদ্ধান্ত আপনার মতো আরো অনেক অভিভাবকই নিয়ে থাকেন। আর ভুলটা সেখানেই। কারণ এই পড়ালেখা তাকে কিছু প্রযুক্তি শেখাবে বটে, কিছু দক্ষতা আয়ত্ত করাবে, কিন্তু ‘মানুষ’ করবে না।
সত্যিকার শিক্ষা হচ্ছে নৈতিকতার শিক্ষা, মানবিকতার শিক্ষা, ধর্মের শিক্ষা, যা একসময় আমাদের এই জনপদে মুনি-ঋষি, সুফি-দরবেশরা আমাদের পূর্বপুরুষদের শিখিয়েছেন। মাদ্রাসাভিত্তিক বা টোলভিত্তিক অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক যে শিক্ষাব্যবস্থা একসময় আমাদের জনপদে প্রচলিত ছিল।
কিন্তু ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ রাজনীতিক লর্ড ম্যাকলে সুপারিশ করেন, এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করা হোক, যা এ ভূখণ্ডের মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের মেরুদণ্ডটা ভেঙে দেবে। উদার মানবিক স্বাধীনতাপ্রিয় জাতিসত্তাকে বদলে করবে ভীরু, স্বার্থপর, আত্মবিশ্বাসহীন কূপমণ্ডূক জাতি। যে শিক্ষায় নৈতিকতার কোনো চেতনা থাকবে না, ধর্মের মানবিকতার জ্ঞান থাকবে না। ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য ভেদাভেদের গুরুত্ব থাকবে না। তা-ই হলো। আজ প্রায় দুশ বছর ধরে আমরা তার পরিণতিই ভোগ করছি।
এর মধ্যে পত্রিকায় দেখলাম, এক মডেল তরুণী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। নিজের মৃত্যুর জন্যে প্রেমিককে দায়ী করে সে লিখেছে, ‘আমাকে ব্যবহার করবা, সেক্সের প্রয়োজন হলেই ডাকবা, আর আমিও ভালবাসার টানে চলে যাব, এদিকে বিয়ের কথা বললে পরিবার অসুস্থ হয়ে যাবে, আমাকে ঘর থেকে বের করে দেবে, এটা তো কোনো কথা না। আমি কি যৌনদাসী হয়ে গেলাম?’
এই তরুণীর জন্যে দুঃখ হয়। প্রেমিকের প্রতারণার শিকার হয়ে কী করুণভাবে তাকে বিদায় নিতে হলো পৃথিবী থেকে। কিন্তু সে নিজেও কি ভুলপথে পা বাড়ায় নি? বিয়ের আগে একজন পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করার আগে কেন তার মনে হলো না যে, এটা পাপ, এটা অনৈতিক?
মনে হয় নি, কারণ এ শিক্ষা সে পায় নি। সে মনে করেছে এটা প্রগতি। ভালবাসার টান! কিন্তু এটা তো ভালবাসা না। এটা বেলেল্লাপনা। বেহায়াপনা। অনৈতিক এ আচরণের জন্যে তার তথাকথিত প্রেমিক যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী সে নিজেও এবং সবচেয়ে বেশি দায়ী হচ্ছি আমরা। অর্থাৎ তাদের অভিভাবকরা, যারা তাদের ছেলেমেয়েদের এই শিক্ষা দিতে পারি নি যে, এটা অন্যায়, এটা করা উচিত না। এটা করলে তুমি প্রতারিত হবে।
এই যে মেয়েটি আত্মহত্যা করল, তার ব্যাকগ্রাউন্ডটা কী? তার বাবা প্রবাসী। তার যখন সাড়ে তিন বছর বয়স তখন মায়ের সাথে বাবার বিচ্ছেদ হয়। এরপর বাবা মেয়েটির লেখাপড়ার খরচ দিয়ে আসছিলেন। সে ঢাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়লেও ও-লেভেল পরীক্ষায় অংশ নেয় নি। মডেলিং জগতে প্রবেশ করে। এজন্যে বাবাও ভরণপোষণের খরচ বন্ধ করে দেন…। অর্থাৎ স্কুলে, বাসায় কোথাও সে কোনো জীবনদৃষ্টি পায় নি। নৈতিকতার শিক্ষা পায় নি। যদি পেত, তাহলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারত যে, আমার জীবনটা আমাকেই গড়তে হবে। আমি ভোগ্যপণ্য নই।
আসলে আমাদের সন্তানেরা যদি বখে যায়, যদি ভুল করে, তাহলে এর দায়িত্ব কিন্তু শুধু তাদের নয়; দায়িত্ব সামাজিকভাবে আমাদের সবার। কারণ আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের এই শিক্ষা দিতে পারি নি। পারলে ৯৯ ভাগ ছেলেমেয়েই ভালো হতো। যেমন, একসময় মানুষ ডাক্তার হতো মানুষের সেবা করার জন্যে। এখন ডাক্তার হয় টাকার পাহাড় গড়ার জন্যে। রোগী যেন টাকা যোগাড়ের এটিএম মেশিন। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, মা-বাবাই তাকে এতে প্ররোচিত করে।
পরিচিত এক ডাক্তার তরুণকে তার বাবা বলেছেন, ১৫ লক্ষ টাকা খরচ করে তোকে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পড়িয়েছি, এখন তুই সমাজসেবা করবি? আমার ১৫ লক্ষ টাকা কে দেবে? অর্থাৎ আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ বানাচ্ছি না। আমরা তাদেরকে পণ্য বানাচ্ছি বা টাকা উপার্জনের মেশিন বানাচ্ছি। তাদেরকে কোনো জীবনদৃষ্টি দিতে পারছি না। তাদেরকে শুধু কামাই করার যন্ত্র বানাচ্ছি যে, কীভাবে কামাই করতে হবে। শুধু কামাই করার যন্ত্র যদি তাকে বানান, যদি নৈতিকতা শিক্ষা না দেন; কী করা উচিত, কী করা উচিত না, এই শিক্ষা যদি তাকে না দেন, তাহলে পরিণতি এমন করুণই হবে।
কাজেই সন্তানকে কোথায় পড়াবেন, সে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে শুধু পড়ার মান দেখাটাই যথেষ্ট নয়। সন্তানের নৈতিক, মানবিক বিকাশটাও গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মের সঠিক জ্ঞান দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। তাহলেই সে প্রকৃত মানুষ হবে।
এবার আসা যাক, ইংলিশ বা বাংলা মিডিয়ামের ব্যাপারে। আপনি যদি আপনার সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতেই চান, থ্রি/ ফোর পর্যন্ত পড়ানোটাই যথেষ্ট। কারণ ইংরেজির একটা ভালো ভিত্তি হওয়ার জন্যে এটুকুই চলে। এরপর তাকে ইংলিশ ভার্সনে নিয়ে আসুন। কারণ এর চেয়ে ওপরে যখন সে যাবে, তখন ইংলিশ মিডিয়ামের নেতিবাচক বিষয়গুলোতেই সে সংক্রমিত হবে, ভালো বিষয়গুলোর চেয়ে।
আর কার্টুন দেখার অভ্যাস দূর করাটা কঠিন। কার্টুনের প্রতি তার আগ্রহ যেন আস্তে আস্তে কমে, সেজন্যে উদ্যোগী হোন। তাকে গল্প শোনান, চিরায়ত সাহিত্য বা রূপকথা বা আকর্ষণীয় ছবি ও গল্পের বই থেকে পড়ে শোনান। অর্থাৎ টিভি নয়, আপনার প্রতি তাকে আগ্রহী করে তুলুন, যেন কার্টুনের চেয়ে আপনি তার কাছে বেশি আকর্ষণীয় হন। কারণ টিভি একটা বস্তু। মানুষের চেয়ে বস্তুর আকর্ষণ কখনো বেশি হতে পারে না। আর আস্তে আস্তে তাকে বোঝাতে হবে যে, কার্টুনে যা দেখাচ্ছে, তা বাস্তব নয়। যখন আরো বড় হবে তখন বলতে হবে, তুমি তো এখন বড় হয়েছ, এগুলো বাচ্চাদের জন্যে।
Related Posts
Q&A Series – Episode 292: Failure is the pillar of success!
Q&A Series – Episode 291: What exactly is visualization?
Q&A Series – Episode 290: How does visualization work?