প্রশ্নঃ আমার ছোট বোন ক্লাস সেভেনে পড়ে। সে সারাক্ষণ তার স্মার্টফোনে সেলফি তোলে। ইদানিং সে নিজের চেহারা ও চুল নিয়ে খুবই হীনম্মন্যতায় ভোগে এবং প্রায়ই আত্মহত্যা করার কথা বলে। তাকে এ সমস্যা থেকে মুক্ত করার উপায় কী।
উত্তরঃ এটা এখন অনেকেরই সমস্যা। এর মধ্যে তো পড়লাম যে, কেউ যদি দিনে ছয়টির বেশি সেলফি তোলে এবং সোশাল মিডিয়ায় তোলার তাড়না বোধ করে তাহলে তাকে নাকি বিজ্ঞানীরা ‘ক্রনিক সেলফাইটিস’ এর রোগী বলছেন। তো সে বিচারে আমাদের আশেপাশে অনেককেই যে এই রোগে আক্রান্ত পাওয়া যাবে তা বলাই বাহুল্য!
ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং সোশাল মিডিয়ার ব্যাপক প্রসারের কারণেই আসলে সেলফিঘটিত এই সমস্যা! একটা গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার কলেজ ছাত্রদের দুই তৃতীয়াংশই এখন নার্সিসিস্টিক বা আত্মকেন্দ্রিকতায় ভুগছে, ৩০ বছর আগের তুলনায় যা অনেক বেশি! তার মানে গত ৩০ বছরে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশাল মিডিয়াসহ ভার্চুয়াল জগতের সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে পড়েছে যে প্রজন্ম, তাদেরই পরিবর্তন হয়েছে! ফেসবুকে নাকি প্রতিদিন আমরা ১৮০ কোটি ছবি আপলোড করি!
আসলে সমস্যাটা কোথায়? সেলফি একজন মানুষের মধ্যে আত্মআসক্তি তৈরি করে! আত্মকেন্দ্রিকতার জন্ম দেয়। নিজেকে ছাড়া সে আর অন্যকিছুকেই ভালবাসতে পারে না। আর এটাকেই মনোবিজ্ঞানে একটা রোগ বা সিনড্রোম হিসেবে দেখা হয়, যার নাম নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেমরোগ! নার্সিসিস্ট বা আত্মপ্রেমরোগীদের মধ্যে একসময় আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দেয়। কেন?
আসলে প্রত্যেকেই নিজেকে সুন্দররূপে প্রকাশ করতে চায় এবং প্রকাশ করার জন্যে সে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে নিজের ছবি তোলে। প্রত্যেকের লক্ষ্যই থাকে পরের ছবিটা আগের ছবির চেয়ে সুন্দর হতে হবে, ভালো হতে হবে। এটা আমি বুঝি, কারণ আমি নিজেও একসময় ফটোগ্রাফার ছিলাম। মানে যুগপৎ নিউজ রিপোর্টার এবং ফটোগ্রাফার! তো ছবি তোলার সময় আমাদেরও লক্ষ্য থাকতো এই ছবিটা যেন আগের ছবির চেয়ে ভালো হয়। তখন তো নিজের ছবি নিজে তোলা যেত না। অন্যের ছবি বা অন্যকিছুর ছবি তুলতে গিয়ে আমাদের এমন মনে হতো।
তো এখন যখন নিজের ছবি সে নিজেই তুলতে পারে, তখন যে এটা আরো বেশি হবে, তা তো বলাই বাহুল্য! একবার সেলফি তোলার পর তার মনে হচ্ছে পরের সেলফিটাকে আরো সুন্দর করতে হবে, তার পরেরটাকে আরো এবং তার পরেরটাকে আরো। নিজের দিকে বার বার তাকাতে তাকাতে একটা সময় চেহারার খুঁতগুলো চোখে পড়তে শুরু করে! আর নিজের চেহারা এমন একটা জিনিস, এর দিকে তাকালে খুঁত চোখে পড়বেই। কারণ আল্লাহ প্রত্যেককে সৃষ্টিই করেছেন এভাবে। ডান পুরোপুরি বামের মতো নয়। ওপর পুরোপুরি নিচের মতো হবে না। এই যে আমরা মোনালিসা বলি, ক্লিওপেট্রা বলি, যুগ যুগান্তর ধরে যারা পৃথিবীতে সৌন্দর্যের প্রতীক বলে বিবেচিত, তারা কি নিখুঁত ছিল? ছিল না!
তাহলে পারফেক্ট সেলফি হবে কীভাবে? তাছাড়া প্রতি মুহূর্তে যে-কোনো পোর্ট্রেটের ১৮০টা অ্যাঙ্গেল থাকে। গুরুত্বপূর্ণ ছবি তোলার জন্যে এজন্যে অনেক সময় একসাথে ১৮টা ক্যামেরা রেডি রাখা হয় যাতে ১৮টা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তোলা যায়। যার মধ্যে একটামাত্র ছবি হবে সেরা!
তো যখন কেউ মোবাইল দিয়ে সেলফি তোলে, বেশিরভাগ সময়ই তো এই বেস্ট অ্যাঙ্গেলটা সে পায় না! ফলে ছবি তুলে তার তৃপ্তি হয় না! নানানভাবে সে চেহারার আপগ্রেড (!) করার চিন্তা করে।
এর মধ্যে দেখছিলাম, ইংল্যান্ডের এক ছেলে নাকি প্রতিদিন ২০০টা সেলফি তোলে! ইনস্টাগ্রামে তার নাকি ৫০ হাজার ফলোয়ার আছে! তো এদের লাইক পাওয়ার জন্যে সে তার চেহারার ‘আপগ্রেড’ করিয়েছে। সেটা কী রকম? দাঁত সাদা করেছে, চিবুক, চোয়াল, ঠোঁট ও গাল ভরাট করেছে, চোখ এবং চুলে বটক্স ইনজেকশন নিয়েছে যাতে চামড়ার কুঁচকানো ভাব কেটে যায়, ভ্রু-তে ট্যাটু করিয়েছে আর জিম করে রোগা হয়েছে।
এতকিছুর পরও কিন্তু তার শান্তি নেই! ছবি নিয়ে বসে থাকে, সেই অপেক্ষায় যে কখন এটা পোস্ট করলে সবচেয়ে বেশি লাইক পড়বে! কোনো ছবিতে যদি লাইক ৬০০-র কম পড়ে, তাহলে নাকি সাথে সাথে সেই ছবি সে ডিলিট করে ফেলে! চিন্তা করেন কী পরিমাণ হীনম্মন্যতা!
আরেকজন নাকি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দিনে ১০ ঘণ্টা কাটিয়ে দিত শুধু সেলফি তোলার জন্যে! তারপরও প্রত্যেকটা ছবিতেই কোনো না কোনো ত্রুটি খুঁজে পেত সে। একপর্যায়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। শেষ পর্যন্ত রিহ্যাবে যেতে হয় তাকে!
শুধু কি এটাই? সেলফি তোলার জন্যে কত ভয়ঙ্কর ঝুঁকিই না নিচ্ছে তরুণরা! আহত হচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে, এমনকি মারাও যাচ্ছে! এক্ষেত্রে অবশ্য এগিয়ে আছে ভারত। ২০১৪-১৫ সালে কার্নেগী মেলোন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্দ্রপ্রস্থ বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে একটি গবেষণা চালায়। এতে দেখা যায়, এসময় বিশ্বজুড়ে ১২৭টি সেলফি সংক্রান্ত মৃত্যুর ৭৬টিই হয়েছে ভারতে।
সেলফি তোলার এই নেশা যে মানুষকে কিরকম বিবেকশূন্য করে ফেলে তার উদাহরণও আছে। সম্প্রতি ভারতের রাজস্থানের একটি রাস্তায় দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে পড়ে আছে তিনজন মানুষ, আর তাদেরকে পেছনে রেখে সেলফি তুলছে একজন পথচারী- এরকম একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেলে সচেতন মহল সোচ্চার হয়ে ওঠে। পরে ঐ তিনজনই মারা যায়। পুলিশ বলছে, সেলফি না তুলে পথচারীদের কেউ যদি এদের চটজলদি হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করতো তাহলে হয়তো মানুষগুলো বেঁচেও যেতে পারতো।
কাজেই বুঝতেই পারছেন, এই সেলফি আসক্তি কত ভয়ঙ্কর হতে পারে! আপনার বোনকে সচেতন করুন। তাকে বোঝান।
Related Posts
Q&A Series – Episode 292: Failure is the pillar of success!
Q&A Series – Episode 291: What exactly is visualization?
Q&A Series – Episode 290: How does visualization work?