Business Care News

Business News That Matters

dice, game, monochrome

প্রশ্নোত্তর সিরিজ – পর্ব ৩২ঃশেয়ার ব্যবসায় জড়িত হতে চাই

প্রশ্নঃ রিটায়ার করার পর প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ প্রাপ্ত টাকাটা ব্যাংকে রাখতে চাচ্ছি না। কারণ এটা সরাসরি সুদের অন্তর্ভুক্ত। এদিকে বাড়তি কিছু আয় ছাড়া সংসার চালানো সম্ভব নয়। তাই আমি শেয়ার ব্যবসায় জড়িত হতে চাই। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত জানাবেন।


উত্তরঃ আপনি কিন্তু কন্ট্রাডিকশনে ভুগছেন। যদি সুদ নেয়াটা আপনার অপছন্দের হয়, তাহলে শেয়ার বাজার নামের জুয়া বাজারের টাকাকে আপনি কীভাবে হালাল মনে করেন? আসলে শেয়ার ব্যবসা সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

শেয়ার ব্যবসার প্রথম ধাপ হচ্ছে প্রাইমারি শেয়ার। প্রাইমারি শেয়ার হলো—একটি কোম্পানি যখন তার মূলধন সংগ্রহের জন্যে বাজারে শেয়ার ছাড়ে এবং ছোট-বড় বিনিয়োগকারীরা সেই শেয়ার কিনে নিয়মিত ব্যবধানে ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশের ভাগীদার হন। কোম্পানি যদি লাভজনক হয়, যদি অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত হয়, আপনার লস হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই।

কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ শেয়ার ব্যবসা বলে যা বোঝে তা হচ্ছে শেয়ার বাজার। আর এই শেয়ার বাজার আসলে জুয়ার বাজার ছাড়া আর কিছু নয়। এটা আমরা বলে আসছি গত ৩০ বছর ধরে। কারণ এস্ট্রলজি করার সময় আমার যেসব ক্লায়েন্ট শেয়ার বাজারে ছিলেন, তাদেরকে কাছে থেকে দেখেছি। দেখেছি তাদের সর্বস্বান্ত হওয়া। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, কোন শেয়ারটা বাড়বে, কোনটা কমবে। আমি বলতাম, দেখুন, শেয়ার দর নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হলে তো আমাকে শেয়ার ব্যবসায়ী হতে হবে। কিন্তু শেয়ার বাজারের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। কারণ এখানে জিততে হলে মাফিয়া চক্রের অংশ হতে হবে। আর তা হতে না পারলে আপাতত যতই ফুলেফেঁপে ওঠেন, একসময় সর্বস্বান্ত হতে হবে।

কারণ আমার মনে ছিল তরুণ বয়সে দেখা তিন তাসের খেলার পরিণতি—যেখানে জুয়ার আয়োজকদেরই সবসময় আমি জিততে দেখেছি, সাধারণ জুয়াড়িদের নয়। কিন্তু তাদেরকে কীভাবে প্রলুব্ধ করা হতো তা দেখেছি। হয়তো আয়োজকদেরই একজন খেলছে। তাকে ঘিরে আছে তিন/ চার জন, তারাও একই দলের, কিন্তু বাকিরা তা জানে না। ঐ জুয়াড়িকে জিততে দেখে যখন নতুন কেউ এলো তাকে খুব উৎসাহ দিয়ে খেলায় নামানো হলো। প্রথমদিকে সে বেশ কয়েকটা দান জিতেও গেল বা তাকে জেতানো হলো। এরপর হারতে শুরু করল। কিন্তু যত হারছে, তত তার জেদ বেড়ে যাচ্ছে। সে ভাবতে থাকে—একবার হেরেছি তাতে কী, পরেরবার যদি জিততে পারি এই পুরো হারটা উসুল করে ফেলব। সে আবার বাজি ধরে এবং একসময় সর্বস্বান্ত হয়ে বিদায় নেয় জুয়ার আসর থেকে। এই পরিণতি তিন তাসের খেলায় যেমন, এখনকার ক্যাসিনোর আসরেও তেমন। ক্যাসিনোতেও জেতে ক্যাসিনোর লোকরাই, সাধারণ জুয়াড়িরা নয়। আর শেয়ার বাজার হচ্ছে এর নব্য সংস্করণ।

এখানে প্রথমে মাফিয়া চক্র নানাভাবে গুজব ছড়িয়ে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনতে থাকে—ফলে সে শেয়ারগুলোর দাম বাড়তে থাকে। ১৯৯৬ সালে এমনও হয়েছে যে, ১০ টাকার শেয়ার ১১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। দাম বাড়ার একপর্যায়ে সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে যখন সেই শেয়ার কেনার ক্রেজ সৃষ্টি হয়, তখন মাফিয়া চক্র তাদের শেয়ারগুলো আস্তে আস্তে বিক্রি করে। এভাবে বাড়তি দামে মাফিয়াদের সব শেয়ার যখন বিক্রি হয়ে গেল, তখনই দেখা গেল যে, ধাঁই ধাঁই করে শেয়ারের দাম পড়ে গেল। হাজার হাজার টাকায় কেনা শেয়ারগুলো সব কাগজ হয়ে গেল।

১৯৯৬ সালে যা হয়েছিল ২০১০ সালেও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। সে সময়ের একটা রিপোর্ট অনেকটা এরকম—বেশ কয়েকদিন ধরেই দেশের শেয়ার বাজার ছিল চড়া। বদৌলতে একের পর এক লেনদেন ও সূচক বাড়ার রেকর্ড হতে থাকে। কিন্তু গতকাল শেয়ার বাজারে সম্পূর্ণ উল্টো পরিস্থিতি দেখা গেছে। এদিন ডিএসই’র সাধারণ সূচক ১৪৭ পয়েন্ট পড়ে যায়। সারাদিনে ২৪৪টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়। এর মধ্যে দরপতন ঘটে ১৮১টির। বাড়ে মাত্র ৬৩টি। দিনশেষে ব্রোকারেজ হাউজগুলো থেকে অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে বিমর্ষ অবস্থায় বাড়ি ফিরতে দেখা যায়। মোট লেনদেন হয়েছে ২,৭১০ কোটি টাকার। [প্রথম আলো, ৭ ডিসেম্বর, ২০১০]

একই রিপোর্টের আরেক জায়গায় আছে, ‘যারা শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে ফায়দা লুটতে চায় তারা আন্তর্জাতিকভাবে বুল কার্টেল হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে বর্তমানে এ ধরনের ১০ থেকে ১৫টি কারসাজিকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। এই বুল কার্টেল চক্র ঢাকা শহরের পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে বৈঠক করে তাদের সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন, বোনাস শেয়ার ইস্যু বা রাইট শেয়ার ইস্যুর মতো বিষয়গুলো গোপনে নির্ধারণ করিয়ে নেয়। এসব বিষয়ে কী ঘোষণা দিতে হবে তারও নির্দেশনা দেয় এই চক্র। তাদের নড়াচড়ার ওপরই নির্ভর করে প্রতি সপ্তাহে দেশের শেয়ার বাজার কেমন যাবে। কোন খাতে শেয়ার বেশি কেনাবেচা হবে। এই জালে আটকা পড়ে প্রতিদিনই সর্বস্বান্ত হচ্ছে অনভিজ্ঞ নতুন অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী।’

অর্থাৎ ক্যাসিনোর মতোই হারজিতের খেলা, চক্রের সহায়তায় সাধারণদের প্রতারিত করা। আবার দেখুন, এই যে ২,৭১০ কোটি টাকার লেনদেনের কথা বলা হলো—এই টাকায় একদিনে কী কাজ হয়েছে? জাতীয় অর্থনীতির কী উপকার হয়েছে? টাকাটা কি কোনো খাতে বিনিয়োগ হয়েছে, না কোনো পণ্য সৃষ্টি করেছে? এ কথাগুলো আমরা গত ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন সময় বলে আসছিলাম। এখন তারই পুনরাবৃত্তি করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ১৭ জানুয়ারি ২০১১ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় কম্যুনিস্ট নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের লেখা নিবন্ধ—বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট : ক্যাসিনো অর্থনীতিতে জুয়ার বাজার। এতে তিনি বলেন, আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে শেয়ার বাজারের গোটা ব্যাপারটি প্রধানত এক ধরনের ফটকা ব্যবসার ভিত্তির ওপর স্থাপিত ও পরিচালিত। প্রকৃতিগতভাবেই শেয়ার ও স্টক মার্কেটের ব্যবসা এক ধরনের জুয়াখেলার মতো ব্যাপার। এখানে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ ও সংস্থা কর্তৃক নিবন্ধিত বিভিন্ন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূলধনের অংশ বা শেয়ার বিক্রির জন্যে বাজারে ছাড়া হয়। বিনিয়োগকারীদের হাত ঘুরে ঘুরে এসব শেয়ারের কেনাবেচা চলে। কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের উন্নতি-অবনতির সাথে সাথে তার শেয়ারের দাম ওঠানামা করবে, এমনটাই তাত্ত্বিকভাবে হওয়ার কথা। কোম্পানির পারফরমেন্সে উন্নতি ঘটবে অনুমিত হলে বিনিয়োগকারীরা পরে বিক্রি করে আরো বেশি দাম পাওয়ার আশায় চলতি দামে তার শেয়ার কিনে রাখে। শেয়ার বাজারে স্টকের (কিনে রাখা শেয়ারের) দাম ওঠানামা সম্পর্কে মনোগত অনুমানের ওপর ভিত্তি করে জুয়াখেলায় ভাগ্য খুঁজে পাওয়ার আশায় তারা শেয়ারের ‘রাখি ব্যবসায়’ টাকা খাটায়। অনেকটাই ঘোড়দৌড়ের খেলায় ঘোড়ার পেছনে বাজি ধরার মতো ব্যাপার।….

শেয়ার বাজার বহুলাংশেই ক্যাসিনো তথা জুয়ার বাজারের মতো একটি স্থান। রাতারাতি বাজিমাত করার লোভ দেখিয়ে লাখ লাখ মানুষকে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে প্রলুব্ধ করা হয়। সহজে মুনাফা লাভের আশায় লোভে পড়ে পেনশনের টাকায়, ঘর-বাড়ি বিক্রি করে, ঋণ করে-নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করে তারা ছুটে আসে শেয়ার বাজারে। উৎপাদনশীল বিনিয়োগ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা চলছে এবং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে ‘সহজে টাকা কামাই’-এর এই প্রলোভনে মরণঝাঁপ দেয়াটা দেশের লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের জন্যে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ‘স্বাভাবিক’ নিয়মেই যখন শেয়ার বাজারে ‘অস্বাভাবিক’ ধস নামে, তখন তাদের পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

এই পরিণতি নেমে আসে সাধারণ ক্ষুদে বিনিয়োগকারীদের ভাগ্যে। কিন্তু শেয়ার বাজারের বড় বড় চাঁই ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অপার আর্থিক সামর্থ্য থাকায় তারা শেয়ার বাজার ধসের সময়ের সংকট উৎরে উঠতে সক্ষম হয়। ফলে ধসের পর শেয়ার বাজার যখন আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে তখন পথে বসা লক্ষ লক্ষ ক্ষুদে বিনিয়োগকারীর হারানো টাকা এসে জমা হয় এই সব বড়-বড় বিনিয়োগকারীর হাতে।….

গত এক মাসের মধ্যে পর পর দুই দফায় আবার শেয়ার বাজারে রেকর্ড দরপতন ঘটেছে। প্রথম দফায় কয়েকদিনে দেড় হাজার পয়েন্ট এবং পরেরবার প্রায় দুই হাজার পয়েন্ট দরপতন ঘটেছে। শেয়ার বাজারের ৩৩ লক্ষ সাধারণ বিনিয়োগকারীর অধিকাংশই ইতোমধ্যে বিপুল লোকসানের শিকার হয়েছে। মোট লোকসান হয়েছিল প্রথম দফায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ১০ জানুয়ারি এক দিনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক পড়ে গিয়েছিল ৬৬০ পয়েন্ট।

দেশের গোটা অর্থনীতি এক ধরনের গোড়ায় গলদ নিয়ে চলছে। শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের যে বিশাল বিস্তৃতি ঘটেছে, সেই তুলনায় পণ্য ও সেবাখাতে প্রবৃদ্ধি অতি নগণ্য। সুতরাং কোনো বস্ত্তগত ভিত্তি ব্যতিরেকে অনেকটা কেবলমাত্র হাওয়ার ওপরে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। এই অবস্থা বাতাসের বুদবুদ অথবা ফোলানো বেলুনের মতো অতি ভঙ্গুর হতে বাধ্য। ইংরেজিতে একে ‘বাবল ইকোনমি’ বলা হয়। এক মুহূর্তের খোঁচায় ফোলানো বেলুনের চুপসে যাওয়ার মতো বাজার সম্পূর্ণ ধসে পড়ে মহামন্দার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য ও সেবাখাতে বিনিয়োগের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার বদলে দ্রুত মুনাফার লোভে শেয়ার বাজারে ঢুকে পড়েছে। এর ফলে শেয়ার বাজার জিম্মি হয়ে পড়েছে বড় বড় বিনিয়োগকারীদের হাতে।

জুয়া এমনিতেই ভাগ্যের খেলা, যে খেলা একসময় নেশার টানে পাকা জুয়াড়িকেও পথের ভিখারি বানিয়ে দেয়। তার ওপরে জুয়ার আসরে যদি জোচ্চুরি থাকে, তাহলে সাধারণ খেলোয়াড়দের সব হারিয়ে ফকির হওয়াটা প্রায় নিশ্চিত একটি ব্যাপার। শেয়ার বাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অবস্থার ফেরে আজ সেই সর্বনাশা ‘ভাগ্যের খেলার’ অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে।’ এই বিস্তারিত আলোচনার পর এখন আপনিই ঠিক করুন কষ্টের সঞ্চয়গুলো এই মাফিয়া চক্রের হাতে তুলে দেবেন কি না।

সুত্রঃ প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড

Skip to content