প্রশ্নঃ একটি ব্যাংকে আমার চাকরি হয়েছে। সামনের মাসে জয়েনিং। আমি জানি, ব্যাংকে লেনদেন ইসলামি শরিয়তের বিধান অনুযায়ী হারাম। আমার মন খুঁতখুঁত করছে। আমার রোজগারের টাকা হালাল হবে তো? হারাম পথে আমি কোনো টাকা আয় করতে চাই না। গুরুজী দয়া করে জানাবেন।
উত্তরঃ ধারের বিনিময়ে সুদ গ্রহণ এবং হারাম ব্যবসায়ে অর্থ বিনিয়োগকে ইসলাম অবৈধ করেছে। শরিয়ার এই রীতি মেনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনার নীতিগত ধারণাটিকেই ইসলামি ব্যাংকিং বলে। খোলাফায়ে রাশেদীনের পর থেকে শুরু করে ৮০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ইসলামের স্বর্ণযুগে যে ব্যাপকভিত্তিক ইসলামি অর্থনীতির বিকাশ ঘটে, তারই অনুপ্রেরণায় ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি মিশরে প্রথম ইসলামি ব্যাংকিং পদ্ধতির প্রচলন হয়। পরবর্তীতে তা বিস্তৃত হয় ইরান, সৌদি আরব এবং মালয়েশিয়ায়।
ইসলামি ব্যাংকিং বলে, সুদভিত্তিক প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিপরীতে তাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালিত হয় লাভ-ক্ষতি ভাগাভাগির শর্তানুসারে। মুদারাবা, মুশারাকা, মুরাবাহা ইত্যাদি নানা নামের অর্থনৈতিক লেনদেনের নিয়ম রয়েছে তাদের। এখন প্রশ্ন হলো, পারস্পরিক নির্ভরশীল বর্তমান বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় কোনো বিশেষ ব্যাংকিং ব্যবস্থার পক্ষে কি বাদবাকি ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে লেনদেন না করে থাকা সম্ভব? আর যখন একই দেশে অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে এবং যেখানে তাদের সবাইকে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বাধ্যতামূলক লেনদেন করতে হয় তখন সেখানে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকিং কীভাবে হবে? আমাদের দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলক একটা জামানত রাখতে হয়, লেনদেন করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক কি ইসলামভিত্তিক লেনদেন করছে, না বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন অনুযায়ী করছে? অর্থাৎ একটা দেশের সব ব্যবস্থা যখন ধর্মনিরপেক্ষ, তখন শুধু ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামি হওয়া সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, কোরআনে যে রিবা বা সুদকে হারাম করা হয়েছে, আলেমদের একটা অংশ—যাদের মধ্যে আল্লামা ইউসুফ আলীও রয়েছেন—তারা মনে করেন, বর্তমান ব্যাংক ব্যবস্থার সুদ তার আওতায় পড়ে না। কোরআনের এই রিবা হলো মহাজনী সুদ যা অনেকসময় আসলের চেয়েও অনেক গুণ বেশি হয়ে যেত এবং তা শোধ করতে না পারলে আমাদের চিরায়ত সাহিত্যের সেই উপেন কিংবা গফুরের মতো ভিটেবাড়ি সব খোয়াতে হতো। শেক্সপিয়ারের মার্চেন্ট অফ ভেনিসের শাইলকের মতো এই মহাজনেরা দেনাদারের ওপর খড়গহস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত।
আর সাধারণ ব্যাংক যাকে সুদ বলে, ইসলামি ব্যাংক তাকেই বলে মুদারাবা বা প্রফিট শেয়ারিং। অর্থাৎ আপনার টাকা খাটিয়ে ব্যাংক যদি প্রফিট করে তাহলে আপনি তার ভাগ পাবেন, কিন্তু লস করলে আপনি কিছু পাবেন না। কিন্তু আপনি যদি ব্যাংকের টাকা নিয়ে লস করেন তাহলে ব্যাংক আপনার এই লস শেয়ার করবে না। তাহলে এটা ব্যবসা হলো কীভাবে? অর্থাৎ সবই এক, শুধু নামগুলো আরবি। যেমন, একসময় লাইফ ইনস্যুরেন্সকে শরিয়ার পরিপন্থি গণ্য করা হতো। এখন এটাকে বলা হয় ইসলামিক ইনস্যুরেন্স বা তাকাফুল। সবই এক শুধু ব্যাখ্যাটা বদলে গেছে যে, একজনের ঝুঁকিকে যখন অনেকে মিলে বহন করেন তখন এর লাভ পেতে অসুবিধা নেই।
ইসলাম শব্দটির সাথে আমাদের দেশের মানুষের যেহেতু একটা দুর্বলতা আছে, সেই সুবাদে ইসলামের নামে অনেকেই লাভজনক ব্যবসা করছেন। তাই এখন এইচএসবিসি এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মতো বহুজাতিক ব্যাংক তাদের সাধারণ ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি ‘সাদিক’ ‘আমানাহ’ ইত্যাদি নামে ইসলামি ব্যাংকিংও চালু করেছে। এটা অনেকটা ইংরেজদের ইংরেজ প্রিন্সিপাল দিয়ে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা চালু করার মতো।
আমাদের কারো কারো বাতিক আছে—ব্যাংকে টাকা রেখেছি, সুদ নেবো না। কিন্তু এই টাকাটা কারা ব্যবহার করছে? এখন সারা বিশ্বের ব্যাংকিং অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে ইহুদিরা। আপনি আপনার টাকা তাদেরকে দিচ্ছেন আরো টাকা বানাবার জন্যে। আপনি সুদ না নিলে তাদের জন্যে আরো ভালো। তাদের টাকা বাড়বে। অতএব আমরা যেন আত্মপ্রতারণার শিকার না হই। যা বাস্তব, তাকে যেন বাস্তবানুগভাবেই গ্রহণ করি। কারণ আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ। এখানে শুধু ব্যাংকিং ইসলামি হতে পারে না। একমাত্র ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যাংকিং শরিয়তসম্মত হবে। তখন আপনি ইসলামি ব্যাংকিং করতে পারবেন।
অতএব আমরা দেখেছি যে, তথাকথিত ইসলামি ব্যাংকিং আর অন্যান্য ব্যাংকিংয়ের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো পার্থক্য নেই। সবাইকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মের অধীনে কাজ করতে হচ্ছে। তারা একই কাজ করছেন, শুধু ভিন্ন নামে ডাকছেন। আর ব্যাংক ছাড়া এবং ব্যাংকের সুদ ছাড়া তো এখন কোনো অর্থনীতি চলছে না। আপনি যেহেতু অন্য কাউকে ঠকাচ্ছেন না এবং যা হচ্ছে সব পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে একটা সিস্টেমের মধ্যে হচ্ছে অতএব ব্যাংকিং সার্ভিসের মধ্যে আমরা হারামের কিছু দেখছি না।