প্রশ্নঃ একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির একার সম্পদ নয়, এর মাধ্যমে দেশ ও জাতি ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়। অনেক বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়, দেশের অর্থনীতি উর্বর হয়। এ কারণে ব্যাংক ৩০% জামানতে শিল্প উদ্যোক্তাকে ১০০% হারে ঋণ প্রদান করে। সুতরাং এ ধরনের শিল্প উদ্যোক্তাকে ঋণগ্রস্ত না ভেবে কি একজন সমাজসেবক ভাবা যায় না?
উত্তরঃ আপনি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এ কথাগুলো বললেন। এটা নিয়ে বলার আগে আমরা বিদেশের প্রেক্ষাপট একটু দেখি। বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানোর জন্যে সে দেশের সরকার এগিয়ে এসেছে। যেমন, দেউলিয়াত্ব থেকে বাঁচানোর জন্যে মার্কিন সরকার জেনারেল মটরসকে ৫০ বিলিয়ন ডলার সাবসিডি দিয়েছিলো। একইভাবে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ব্যাংক-স্কটিশ ব্যাংককে দেউলিয়াত্ব থেকে বাঁচানোর জন্যে যুক্তরাজ্য সরকার বিশাল অঙ্কের অর্থসাহায্য দিয়েছে। এখন আপনি বলুন, এ টাকাগুলো কাদের টাকা? জনগণের টাকা। কাকে বাঁচানোর জন্যে দিয়েছে? পুঁজিপতিদের বাঁচানোর জন্যে।
অর্থাৎ শোষকদের বাঁচানোর জন্যে দিচ্ছে জনগণের টাকা! কেন? কারণ একটা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা পুঁজিবাদী অর্থনীতির জন্যে ক্ষতিকর। একটা একটা করে যদি সবগুলো ব্যাংক বন্ধ হয়ে যেত তাহলে আমেরিকার কী অবস্থা হতো? কাজেই সরকার যখন একটা শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে সাহায্য করে, তার উদ্দেশ্য থাকে পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে রক্ষা করা, সমাজসেবা নয়। যদি একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান সমাজসেবা করে চলতো তাহলে কিন্তু তারা সাহায্য চাইতো না, দেউলিয়া হয়ে গেলে তারা সব বেচে দিয়ে জনগণকে ঐ টাকা বিলিয়ে দিতো। তা কিন্তু হয় না। তারা আমাদের টাকা দিয়ে ব্যবসা করে, আমাদেরকেই শোষণ করে। আবার বিপদে পড়লে আমাদের ট্যাক্সের টাকা দিয়েই তারা টিকে থাকে। এর পেছনে কিন্তু কোনো একক ব্যক্তি বা সরকার দায়ী নয়। দায়ী হলো সিস্টেম।
ধরুন, আমরা এতদিন কী দেখলাম? বিশ্বের প্রথমসারির বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং অন্যতম বৃহত্তম কয়েকটা ব্যাংক হুট করে বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং সেগুলোকে বাঁচানোর জন্যে আমেরিকার মতো দেশের সরকারকে বাইরের দেশ থেকে পর্যন্ত অর্থ সাহায্য নিতে হয়। তাহলে এই সিস্টেমটা কত খারাপ! এবার আসি আমাদের দেশের প্রসঙ্গে। আমাদের দেশে যারা ঋণ নিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন, আজ পর্যন্ত কেউ কি টাকা শোধ করেছেন? খুব কম। কারণ যারা ঋণ নেন, তারা সমাজসেবা করার জন্যে ঋণ নেন না। তারা শিল্প প্রতিষ্ঠান করার জন্যে, ব্যবসা করার জন্যে ঋণ নেন। ঋণখেলাপি হওয়ার জন্যে ঋণ করেন। মার্চ ১৯৯২ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকে ঋণখেলাপির সংখ্যা এক লাখ ২২ হাজার ৪৩৭ জন। আমাদের দেশে তারা হচ্ছেন ‘সম্মানিত ঋণখেলাপি’ কারণ তারা থাকেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
এই যে ঋণের টাকা-এগুলো আসে কোত্থেকে? জনগণের পকেট থেকে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে। শিল্পকারখানায় যে ঋণ হয়-এই ঋণের অধিকাংশ হচ্ছে বিদেশি ঋণ। আইডিবি বা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এসব ঋণের টাকা দেয়। শিল্পব্যাংকের টাকা এসেছে কোথা থেকে? বিদেশি ঋণ থেকে এবং এই টাকা শোধ দিতে হচ্ছে কাকে? জনগণকে। অতএব মূল জিনিসটা হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি। আপনি যে ভাবছেন একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনীতির উপকার করছে-সেটা একদিক থেকে ঠিক। কিন্তু উপকারের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা আর অনেকগুলো ভাঁওতাবাজিকে ঢাকার জন্যে কিছু ভালো কাজ করা-এ দুটোর মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।
আসলে আপনি যদি মানুষের সেবা করতে চান আপনার ঋণের কোনো প্রয়োজন নাই। মানুষই আপনাকে টাকা দেবে। একজন ব্যবসায়ী সে পর্যন্তই সফল থাকে যতক্ষণ সে মানুষের টাকা নিয়ে ব্যবসা করে। যখনই সে ব্যাংকের টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করে, তখন সে আটকা পড়ে যায়। যদিও কথাটা আপনাদের কাছে পরস্পরবিরোধী মনে হবে। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। কারণ আমাদের সমস্যাটা হচ্ছে সিস্টেম। ঋণ নেয়ার মধ্যে অনেক ব্যাপার আছে, প্রজেক্ট পাশ করানোর মধ্যে অনেক কায়দা আছে। ওগুলো করাতে করাতে আপনার নিজের পকেট থেকে যে পরিমাণ অর্থ বেরিয়ে যাবে তারপর আপনি নিজেই মনে করবেন যে, এবার অন্যকে টাকা দেয়া বন্ধ করে একটু নিজে কামাই করি।
কারণ স্রেফ সুদ হিসেবে যে পরিমাণ টাকা আপনাকে বছরের পর বছর ব্যাংককে দিতে হবে তারপর আর মূল টাকা ফেরত দিতে চাইবেন না। এবং এতে আপনার যেরকম লাভ, তেমনি ব্যাংকেরও লাভ। মাঝখান দিয়ে বাড়তি ঋণের টাকা গুনতে হয় জনগণকে। কাজেই একতরফাভাবে কাউকেই দোষারোপ করতে চাই না। আমরা চাই সিস্টেমটা সুন্দর হোক-যেটা জনগণের জন্যে কল্যাণকর হবে। যেখানে মানুষ বিনিয়োগ করবে এবং বিনিয়োগের ফসল সে তুলে নিতে পারবে। তার আগ পর্যন্ত আমাদের বাস্তবতার সাথেই মানিয়ে চলতে হবে।
Related Posts
Q&A Series – Episode 292: Failure is the pillar of success!
Q&A Series – Episode 291: What exactly is visualization?
Q&A Series – Episode 290: How does visualization work?