প্রশ্নঃ এমএলএম বা নেটওয়ার্কিং আমাদের দেশে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ ও যুব কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করে অনেক শিক্ষিত যুবক মোটা অঙ্কের কমিশনও পাচ্ছে; কিন্তু আপনি এখানে জড়িত থাকতে নিষেধ করছেন-এর কারণ ব্যাখ্যা করবেন কি?
উত্তরঃ আসলে যে নেটওয়ার্কিংয়ের কথা আপনি বলছেন তা পাশ্চাত্যে পিরামিড স্কিম নামে পরিচিত প্রতারণার ১০০ বছরের পুরনো পদ্ধতি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল কাজ হচ্ছে নতুন সদস্য ভর্তি এবং তাকে কেন্দ্র করে অর্থের আদান-প্রদান। এখানে প্রত্যেক সদস্য ভর্তির সময় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিচ্ছে। আবার সে যখন নতুন সদস্য যোগাড় করছে তখন সে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন পাচ্ছে। এই কমিশনের টাকা আসছে নতুন সদস্যরা ভর্তির সময় যে ফি প্রদান করছে সেখান থেকে।
ব্যবসায়িক মডেল হিসেবে নেটওয়ার্কিং যে ব্যর্থ হতে বাধ্য তা বহুদিন আগেই প্রমাণিত হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, প্রতিটি সমাজেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সদস্য হতে আগ্রহী বা আর্থিকভাবে সক্ষম মানুষের সংখ্যা সীমিত। একটি সময় আসবেই যখন প্রতিষ্ঠান একটি থিতানো অবস্থায় পৌঁছবে, ভর্তি করার মতো নতুন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর পুরনো সদস্যদের কমিশন যেহেতু আসছে নতুন সদস্যদের ভর্তি ফি থেকে, যারা এই থিতানো অবস্থার কিছুটা আগে সদস্য হয়েছে, তারা কেউ কোনো কমিশন পাবে না। বরং নিজেরা যে ফি দিয়ে ভর্তি হয়েছে তা-ও হারাবে।
যদিও এ ধরনের স্কিমগুলোর অনেক রূপ আছে, তবু আলোচনার সুবিধার্থে ধরুন, আপনি তিন হাজার টাকা দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেন। প্রতিষ্ঠানের নিয়ম হচ্ছে, দুহাতে দুজন নতুন সদস্য ভর্তি করতে পারলে আপনি দেড় হাজার টাকা কমিশন পাবেন। অতএব ভর্তি হওয়ার জন্যে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলেন তার সমপরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে হলে আপনাকে চারজন ভর্তি করতে হবে।
এখন মনে করুন, প্রথম স্তরে আপনার মতো মোট পাঁচজন ভর্তি হয়েছে। আপনারা প্রত্যেকেই চারজন করে ভর্তি করলে দ্বিতীয় স্তরের সদস্য সংখ্যা হবে ২০ জন। তারা প্রত্যেকে চারজন করে ভর্তি করলে তৃতীয় স্তরের সদস্য সংখ্যা হবে ৮০ জন। এভাবে চলতে থাকলে চতুর্দশ স্তরে সদস্য সংখ্যা হতে হবে ৩৩ কোটির বেশি-বাংলাদেশের জনসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি!
সপ্তদশ স্তরে এসে সদস্য সংখ্যা হতে হবে দুহাজার কোটির বেশি, অর্থাৎ পৃথিবীর জনসংখ্যার চেয়ে তিনগুণ বেশি! অতএব ব্যবসায়িক মডেল হিসেবে এটি কতখানি অস্থায়ী তা সহজেই বোঝা যায়। বাংলাদেশে তিন হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী লোকের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক কম। যদি ৫০ লক্ষও হয়, তারপরও একাদশ স্তরের পর নতুন সদস্য খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ফলে একাদশ স্তরে যে ৫০ লক্ষাধিক সদস্য রয়েছেন তারা প্রত্যেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অর্থাৎ মোট সদস্যের তিন চতুর্থাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। লক্ষ করুন, যখনই থিতানো অবস্থায় পৌঁছাক না কেন, শেষের স্তরের প্রত্যেকেই পুরো টাকাটা হারাবেন। যেহেতু প্রত্যেক স্তরে সদস্যসংখ্যা এর আগের স্তরের চারগুণ, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মোট সদস্যের প্রায় তিন চতুর্থাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এ উদাহরণটিতে আমরা ধরে নিয়েছি, প্রত্যেক সদস্য চারজন নতুন সদস্য যোগাড় করবে। যদিও প্রথম দুএক স্তরের সদস্যরা প্রত্যেকে আরো বেশি সদস্য যোগাড় করবে এবং প্রতিষ্ঠান আরো দ্রুত থিতানো অবস্থায় পৌঁছাবে; ক্ষতিগ্রস্ত সদস্যের অনুপাতও বেড়ে যাবে। সারকথা এটিই যে, এ ধরনের ব্যবসায় লাভবান হন তারাই যারা ওপরের দুএকটি স্তরে থাকেন, অর্থাৎ উদ্যোক্তা বা প্রতারক গোষ্ঠি। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে এই নেটওয়ার্কিং বা পিরামিড স্কিমের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসের ১২ তারিখে বেশ কয়েকটি পিরামিড স্কিমের ধসের পর কলম্বিয়ার পাস্টো, টুমাকো, পপায়ান ও সান্টাডের দ কুইলিচাও শহরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ উচ্চহারে লাভের লোভে এসব স্কিমে বিনিয়োগ করেছিলো। কোনো আইনের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কয়েক বছর ধরে স্কিমগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায়। শেষ পর্যন্ত জনগণের বিক্ষোভের মুখে কলম্বিয়া সরকার দেশে ‘অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় এবং প্রতারকদের গ্রেফতার করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দেয়।
বর্তমানে আলবেনিয়া অস্ট্রেলিয়া ব্রাজিল বুলগেরিয়া কানাডা চীন কলম্বিয়া ফ্রান্স জার্মানি হাঙ্গেরি আইসল্যান্ড ইরান ইটালি জাপান মালয়েশিয়া মেক্সিকো নেপাল নেদারল্যান্ড নিউজিল্যান্ড নরওয়ে ফিলিপিন্স পোল্যান্ড পর্তুগাল রুমানিয়া শ্রীলংকা সুইজারল্যান্ড থাইল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ও সাউথ আফ্রিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই কোনো পণ্য বা সেবা প্রদান ছাড়া শুধুমাত্র কমিশনের বিনিময়ে ক্লায়েন্ট যোগাড় আইনগতভাবে নিষিদ্ধ।
আমাদের দেশেও কিন্তু নেটওয়ার্কিং ব্যবসা নতুন নয়। ১৯৯৭ সালে প্রথম জিজিএন নামে একটি নেটওয়ার্কিং কোম্পানি এলো বাংলাদেশে। আমার এখনো মনে আছে, চট্টগ্রামে পরিচিতি সভা হবে। আগ্রাবাদ হোটেলে ঢুকছি। এক গ্রাজুয়েট হঠাৎ এসে বললো, গুরুজী, আসসালামু আলাইকুম। একটা বড় কাজে যাচ্ছি, দোয়া করবেন। তখন তো গ্রাজুয়েট কম ছিলো, কথা বলার সুযোগ ছিলো, আর আমি একটু আগেও গিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কী কাজ? সে বললো, ‘জিজিএন’। জানতে চাইলাম, এটা আবার কী জিনিস? আমি তখনো এ সম্পর্কে শুনি নি। সে সবকিছু খুলে বললো।
জিজিএন হচ্ছে গ্লোবাল গার্জিয়ান নেটওয়ার্ক-এভাবে কাজ করে। আমি যেহেতু সাংবাদিকতা করতাম, আমেরিকাতে এ ধরনের প্রতারণার ফাঁদের কথা বহুদিন আগেই শুনেছি। আমি বললাম, তোমার মা-বাবা অনেক নেক কাজ করেছিলেন নিশ্চয়ই, সেজন্যে ওখানে যাবার আগে আমার সাথে তোমার দেখা হয়েছে। টাকাপয়সা দাও নি তো? বললো, না, দিতে যাচ্ছি। বললাম, তাহলে আর জমা দিও না। তুমি খুব ভাগ্যবান। প্রতারিত হওয়া থেকে বেঁচে গেলে। সে আর টাকা জমা দেয় নি।
পরে শুনলাম, আমাদের গ্রাজুয়েটদের মধ্যে কেউ কেউ ঢাকা থেকে চিটাগাং চলে গেছে ক্লায়েন্ট যোগাড়ের জন্যে। তারা বলছে, গুরুজীর স্বপ্ন- সবাই প্রাচুর্যবান হবে। জিজিএন এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে এসেছে। আবার তারা বলে দিয়েছে, যেন আমার কাছ পর্যন্ত কথা না আসে। খোঁজ লাগালাম, এক এক করে সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম। বললাম, দেখ বাবা, এই নেটওয়ার্কিং, এমএলএম-এগুলো হচ্ছে প্রতারণা। তোমরা দুই বছরের মধ্যে বুঝতে পারবে কত বড় প্রতারণার শিকার হয়েছো। একজন বললো, গুরুজী, আপনি তো ইকোনমিকস-এর ছাত্র না, বুঝবেন না এর কী সম্ভাবনা! দেখবেন এই টাকায় আমি মেডিটেশনের জন্যে এয়ারকনডিশনড হল বানাবো। সেই হলে মেডিটেশন করবো, আপনি আসবেন মেডিটেশন করাতে।
আমি বললাম যে, মেডিটেশন হল যারা বানানোর, তারা এমনিই বানাবে, তাদের জিজিএন করার প্রয়োজন হবে না। আমরা সাংগঠনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, জিজিএন-এর সাথে যে থাকবে ফাউন্ডেশন থেকে তাকে বহিষ্কার করা হবে। নিরীহ মানুষের সঙ্গে প্রতারণায় ফাউন্ডেশনের কাউকে সহযোগিতা করতে দেবো না। দুবছরের মাথায় আমাদের আরেক গ্রাজুয়েট এসে খবর দিলো যে, সেই জিজিএনওয়ালা বহিষ্কৃত গ্রাজুয়েট জীবিকার জন্যে এখন বাসে বাসে ফেরি করে কলম, খেলনা ইত্যাদি বিক্রি করছে।
এই হচ্ছে জিজিএন-লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতারিত হয়েছে। এখন আমাদের দেশে যেসব নেটওয়ার্কিং, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান কাজ করছে এগুলো সবই জিজিএন-এর ভূত। যখন ‘নেটওয়ার্কিং’ শব্দটার বদনাম হয়ে গেল, জিজিএন ব্যর্থ হলো-তারপর নিউওয়ে বাংলাদেশ, এবং-আরো অনেক নামে একই ধরনের প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়েছে।