প্রশ্নঃ অপচয়ের প্রবণতাটি তো আসলে বড়লোকদের ব্যাপার। আমাদের মতো ছা-পোষা মানুষেরা কীভাবে অপচয় করবে?
উত্তরঃ আসলে অপচয়ের ব্যাপারটি এত ব্যাপক এবং সূক্ষ্ম যে, শুধু উচ্চবিত্ত নয়, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের মধ্যেও এ প্রবণতা রয়েছে। একজন গার্মেন্টস মালিকের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, তার কর্মীদের আয়ের একটা বড় অংশই প্রতিমাসে চলে যায় তার প্রতিষ্ঠানের নিচের তলায় যে ছবি তোলার স্টিটুডিও রয়েছে সে দোকানে নিজেদের ছবি তুলে।
চা-শ্রমিকদের জীবনও একইরকম। সপ্তাহ শেষে যে মজুরি এ শ্রমিকরা পায়, সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফেরার পথে তা নিয়ে সে প্রথমে ঢোকে রাস্তার পাশে মদের দোকানে। মদ এবং জুয়ার পেছনে সব পয়সা খরচ করে শেষ রাতে শূন্য হাতে সে বাড়ি ফেরে। বাধ্য হয়ে পরদিন তাকে চাল-ডাল কিনতে হয় ধার করে। যে কারণে চা-শ্রমিকরা কখনো ঋণমুক্ত থাকতে পারে না, সবসময়ই তাকে চলতে হয় ধারকর্জ করে। তারা কখনো শ্রমিক-জীবন ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। বংশ-পরম্পরায় তারা সবাই চা-শ্রমিক। কারণ শ্রমিক, সাপ্তাহিক উপার্জন, মদের দোকান এবং পরদিন আবার শ্রমিক—এই চক্রেই ঘুরপাক খাচ্ছে তারা।
আমাদের এখনকার সমাজেও এই একই বাস্তবতা। মনে হয় যে, ধনীরাই বোধ হয় শুধু অপচয় করে। ধনীরা দৃশ্যত অপচয় করলেও অনেক ক্ষেত্রেই আসলে তা তাদের বিনিয়োগ। কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মানুষ মিডিয়ার চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে অপ্রয়োজনীয় যে ব্যয় করে ফেলে, তার পুরোটাই তার অপচয়।
ইদানীং এ অপচয়ের জ্বলন্ত উদাহরণ হলো, মোবাইল ফোনের দৌরাত্ম্য। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই ছুটছে এ মোবাইলের পেছনে। কিন্তু প্রভাবটা গরিবের ওপর যেমন, ধনীর ওপরে তো তা নয়।
আমাদের দেশে এখন মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাত কোটি। ১৫ কোটি মানুষের দেশে সাত কোটি অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক মানুষের কাছে মোবাইল আছে। মোবাইলের হয়তো কিছু কার্যকারিতা আছে। সহজ যোগাযোগ, ব্যবসা, তথ্যের আদান-প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা হয়েছে। কিন্তু সবক্ষেত্রে কি তা-ই?
বিশেষত, তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ যেভাবে এখন মোবাইল-আসক্ত হয়ে পড়েছে তা কি তাদের জন্যে কল্যাণকর হচ্ছে? অহেতুক আড্ডা, এসএমএস, অপ্রয়োজনীয় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া এবং সময় অপচয় করে পড়াশোনা নষ্ট—এসবের একটা বড় কারণই হচ্ছে এই মোবাইল।
কেন তার মোবাইল লাগবে? কারণ সে তার ক্লাসের বন্ধুদের দেখেছে তাদের হাতে হাতে খুব দামি মোবাইল সেট। টিভিতে বিজ্ঞাপনে দেখছে মোবাইল থাকলে এটা হয়, সেটা হয় ইত্যাদি। ফলে অনেক সময় সামর্থ্য না থাকলেও মা-বাবাকে বাধ্য করে মোবাইল কিনে দিতে, কখনো বা বাসা থেকে টাকা চুরি করে মোবাইল কেনে।
এমনও হয়েছে—মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায়, তাকেও তার স্কুলপড়ুয়া ছেলের চাপে বাধ্য হয়ে ধার করে মোবাইল কিনে দিতে হয়েছে এবং এর মাধ্যমে গরিবের কষ্টার্জিত অর্থ কিন্তু চলে যাচ্ছে ধনীর পকেটেই। ফলে গরিব আরো গরিব হচ্ছে এবং ধনী হচ্ছে আরো ধনী।
অর্থাৎ নিজের অজান্তেই অপচয়-অপব্যয়ে জড়িয়ে কোটি কোটি টাকা আমরা তুলে দিচ্ছি বহুজাতিক কোম্পানির বিদেশি মালিকগোষ্ঠীর কাছে এবং এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আমাদের অজ্ঞতা বা অবিদ্যা। পাঁচ টাকা দিয়ে চীনাবাদাম না খেয়ে আমরা ১৫ টাকা দিয়ে চিপস খাই। বাসায় পাঁচ টাকার আলু দিয়ে যে ফ্রেঞ্চফ্রাই তৈরি করা যায়, তা ৮০ টাকা/ ১০০ টাকা দিয়ে কিনে খাই ফাস্টফুড শপে। কারণ আমরা ভাবি, এতেই বোধহয় পুষ্টি বেশি, ফুটানি বা আভিজাত্য বেশি।
তথ্যসূত্রঃ প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড