প্রশ্নঃ আমাকে যদি কেউ অপমান করে আর আমি যদি মুখ বুঝে তা সহ্য করি, মানুষ তখন খুব সুযোগ পেয়ে যায়। অপমান করার মাত্রাও বেড়ে যায়। আমার স্বামী খুব শান্ত ভদ্র। তার সহধর্মিণী হওয়ার সুবাদে সারাজীবন আমাকে অনেক ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়েছে। উনি কোনোদিন ন্যায়ের পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদ করতে পারেন নি। এমনকি ছেলেমেয়েরাও আমাকে অবলীলায় খারাপ কথা বলে। কারণ তারা জানে, যত অন্যায় কথাই বলুক ওদের বাবা মাথা উঁচু করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে না। আমার মা বলতেন—মানুষ শক্তের ভক্ত নরমের যম। আর আপনি বলেন, প্রো-একটিভ থাকতে। গুরুজী, আপনি এগুলোর কী ব্যাখ্যা দেবেন?
উত্তরঃ আপনার ছেলেমেয়ে আপনাকে গালিগালাজ করবে আর আপনার স্বামীকে আসতে হবে ছেলেমেয়ের হাত থেকে আপনাকে বাঁচানোর জন্যে! তাহলে বুঝতে হবে, মা হিসেবে আপনি ব্যর্থ। ছেলেমেয়ে কেন মাকে খারাপ কথা বলবে? দুটো কারণ হতে পারে। এক হচ্ছে, ছেলেমেয়ে কাদের সাথে মিশেছে, আপনি সেদিকে ঠিকমতো নজর দেন নি।
দুই হচ্ছে, ছেলেমেয়েকে আপনি বকাবকি করেছেন, তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন। যখন ছোট ছিল তখন তারা বকাবকি গালিগালাজ এসব শুনেছে। এখন তাদের গলার স্বর বড় হয়েছে, ফলে ছেলেমেয়ে আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করছে। একটা সময়ের পরে তো আসলে ছেলেমেয়েকে বকা যায় না। ছেলেমেয়েকে বোঝাতে হয়। কারণ তখন যদি আপনি তাকে বকা দেন বা মারেন, সে-তো হাতটা ধরে ফেলবে, যদি তাকে আদব শিক্ষা দিয়ে না থাকেন। এটা খুব নির্মম সত্য।
আপনার সন্তান এখন গালিগালাজ করছে, কারণ সে কোনো নৈতিক শিক্ষা পায় নি। সন্তানকে যদি আদব শিক্ষা না দেন, সে-তো এমন করবেই। বাবা-মাকে বকা দিলে দোষটা সন্তানের নয়, বরং দোষটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মা-বাবার। ৯৫% ক্ষেত্রে মা-বাবা সন্তানের সাথে যে-রকম আচরণ করেন, সন্তান বড় হয়ে সে-রকম আচরণই করবে। সন্তানকে যদি না মারেন, সন্তান কখনো সেভাবে বেয়াদবি করবে না। শতকরা পাঁচ ভাগ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে যে, সঠিক শিক্ষা দেয়ার পরও সন্তান সেই শিক্ষা গ্রহণ করে নি।
আসলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা আর অন্যায়ের প্রতিকার করা এক জিনিস নয়। মুখ বুজে গালিগালাজ সহ্য করতে তো আমরা বলি নি। কোয়ান্টামে আমরা সবসময় বলি, অন্যায়ের প্রতিবাদ নয়, প্রতিকার করতে হবে। একজন অন্যায় করল, আপনি রাস্তায় গিয়ে ভাঙচুর করলেন। এটা নির্বোধের আচরণ ছাড়া কিছু না। অতএব সবসময় মনে রাখবেন, দুর্বলের অস্ত্র হচ্ছে প্রতিকার। দুর্বলের অস্ত্র হচ্ছে অহিংসা, বিনয়। আর যদি সবল হন তো এমনিতেই কেউ বকাবকি করতে আসবে না। বকাবকি করছে মানেই হলো আপনি অন্তর্গত শক্তিতে শক্তিমান না অথবা সে আপনার শক্তিকে ভয় পায় না।
তাই গালিগালাজ যত করে করুক, আপনি প্রো-একটিভ থাকুন। প্রো-একটিভ মানে আরেকজন জুলুম করে যাবে, আপনি নীরবে সহ্য করবেন তা নয়। জুলুম, অপমান বা এসব নকল নোট না নেয়াটা হচ্ছে প্রো-একটিভ থাকা। আসলে গালি দেয়া অসভ্য মানুষের কাজ। আপনাকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। ওটাতে জড়ানো যাবে না। যেমন, একজন ময়লা ফেলছে। আপনি কি দাঁড়িয়ে থাকবেন, না সরে যাবেন?
একজন লাঠি নিয়ে আপনাকে পেটাতে আসছে। যদি আপনার হাতটা শক্ত থাকে, তো তার হাতটা ধরে ফেলবেন। আর শক্তি না থাকলে, বুদ্ধি প্রয়োগ করে তাকে এড়িয়ে যেতে হবে। আহাম্মকের মতো মার খেলে চলবে না। এটা হচ্ছে প্রো-একটিভ আচরণ। একজন হয়তো অহেতুক ঝগড়া বাঁধাতে চাইছে। ঝগড়ার আর্ট হচ্ছে, সে প্রথমে আপনার গায়ে ধাক্কা দেবে। যখনই দেখছেন তার সাথে শক্তিতে পারবেন না, তাকে উল্টো বলবেন—ভাই/ আপা, আপনি ব্যথা পান নি তো?
অর্থাৎ আপনি তাকে উত্তেজিত হওয়ার সুযোগ দিলেন না। ফলে আপনি মার খাওয়া থেকে বেঁচে গেলেন। আর যদি শক্তি থাকে, শুধু তাকাবেন। কিছুই বলতে হবে না। সে সরে যাবে। অর্থাৎ আপনাকে বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে। আল্লাহ এই ব্রেনটা দিয়েছেন দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়ানোর জন্যে। তাই কখনো হিংসা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, গালিগালাজ—এসব কোনোকিছুর মধ্যে জড়াবেন না। এগুলো হচ্ছে নেতিবাচকতা।
আর নেতিবাচকতা কখনো কোনো কল্যাণ আনে না। নেতিবাচকতা দিয়ে কারো মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনা যায় না। নেতিবাচক কথা বলে ছেলেমেয়েকে শোধরানো যায় না। যদি শোধরাতে হয়, তাহলে ইতিবাচকতা দিয়ে, মমতার ভাষা দিয়ে বোঝাতে হবে। ছেলেমেয়ের সাথে কী আচরণ করতে হবে—এটা প্রত্যেক বাবা-মাকে আয়ত্ত করতে হবে। ছেলেমেয়ে বখে যেতে পারে। কিন্তু সেটা হবে বাইরে। আপনার সামনে সে বিনয়ী থাকবে। সেই ব্যক্তিত্ব আপনাকে সৃষ্টি করতে হবে।