Business Care News

Business News That Matters

stress, business people, businessman

প্রশ্নোত্তর সিরিজ – পর্ব ১১৯: স্ট্রেস বা টেনশনের আসল কার্যকারণ কী?

প্রশ্নঃ স্ট্রেস বা টেনশনের আসল কার্যকারণ কী?


উত্তরঃ স্ট্রেস বা টেনশনের জৈব-রাসায়নিক কার্যকারণটি যদি আমরা বুঝি তাহলে স্ট্রেস থেকে মুক্ত থাকাও সহজ হবে। আসলে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রাণী-দেহের এক জৈবিক প্রক্রিয়ার নাম স্ট্রেস। লক্ষ লক্ষ বছর আগে মানুষ যখন গুহায় বা জঙ্গলে বাস করত, হিংস্র জন্তু-জানোয়ার বা শত্রুর মোকাবেলায় এই স্ট্রেস রেসপন্সই তাকে লড়তে অথবা পালাতে শক্তি যোগাত।

কী হয় এই স্ট্রেস রেসপন্সে? আমরা যখন কোনো বিপদ অনুভব করি তখন হাইপোথ্যালামাস নামে ব্রেনের একটা ছোট অঙ্গে রাসায়নিক সংকেত প্রেরিত হয়। সিম্পেথেটিক নার্ভাস সিস্টেম তখন নানা ধরনের স্ট্রেস হরমোন তৈরি করে। যেমন-এড্রিনালিন, নরএড্রিনালিন , কর্টিসল। এই স্ট্রেস হরমোনগুলো তখন রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে আমাদেরকে পালিয়ে যেতে অথবা লড়াই করতে সাহায্য করে। তখন হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয় এবং বৃহৎ পেশিগুলোতে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। চামড়ার নিচে রক্ত কণিকাগুলো সংকুচিত হয় যাতে এক্সিডেন্ট হলে বেশি রক্তপাত না হয়। চোখের মণি বড় হয়ে যায় ফলে আমরা ভালো দেখতে পাই। ব্লাডসুগার বেড়ে যায় দেহে শক্তির যোগান দেবার জন্যে। হজম এবং প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়। গ্রোথ হরমোন নি:সরণ বন্ধ হয়ে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যাহত হয়। আর এই সবগুলো প্রক্রিয়াই হয় যাতে আমরা জোরে দৌড়ে পালাতে পারি বা লড়াই করতে পারি।

প্রশ্ন হলো, এখন তো আর বন্য জন্তু-জানোয়ার নেই, তার সাথে লড়াই করা বা পালানোরও প্রয়োজন নেই। তাহলে এখন কেন আমরা স্ট্রেস ভারাক্রান্ত হই? এখনকার স্ট্রেসের কারণ আপনার বিপদ নয়, বিপদের কল্পনা; বনের বাঘ নয়, মনের বাঘ; বাস্তবতা নয়, আপনার মানসিকতা। হয়তো আপনার বাচ্চাটি বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ, নানারকম টেস্ট করিয়েও কিছু ধরা পড়ছে না। অফিসে আগামীকাল অডিট টিম আসবে হিসেবপত্র সব ঠিক আছে কি না দেখার জন্যে বা সহকর্মীর সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে—এ অবস্থাগুলোয় আপনার কোনো বাস্তব বিপদ না থাকলেও আপনার ব্রেনে বেজেই চলেছে নিরন্তর এক ডেঞ্জার এলার্ম যা আসলে ১০০%-ই ফলস এলার্ম। কারণ আপনার ব্রেনের সমস্যা বা সম্ভাবনা যেটাই বলুন তা হলো, ব্রেন বাস্তব ও কল্পনার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। বাস্তব বিপদে ব্রেন যে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, কাল্পনিক বিপদেও সেই একই প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

ধরুন, আপনার ব্রেনে একটা ফায়ার এলার্ম আছে। আগুন লেগেছে বুঝলেই তা বেজে ওঠে। কিন্তু যদি এমন হয় যে, আগুনের কল্পনা করলেও তা বেজে ওঠে এবং দেহকে তৎপর করে তোলে তা মোকাবেলার জন্যে, তখন? আমরা যখন স্ট্রেসে আক্রান্ত হই, তখন এ ব্যাপারটিই ঘটে। বাস্তব বিপদ না হলে বা তা কেটে যাওয়ার পরও ব্রেনের স্ট্রেস রেসপন্স হতেই থাকে। ফলে প্রত্যেকবার জ্যামে পড়লেই আপনার মেজাজ খিঁচে ওঠে, মোবাইল খুলে বসের মিসড্ কল দেখলে টেনশন করেন বা সন্ধ্যাবেলায় টিভির খবর দেখতে বসলেই অনিশ্চয়তায় ভারাক্রান্ত হন।

এখন এই স্ট্রেসের পরিণতি কী? ছোট ছোট রক্তক্ষরণ থেকে যেমন মৃত্যুও হতে পারে তেমনি ছোটখাটো স্ট্রেসগুলোই যদি সবসময় আপনাকে ভারাক্রান্ত করতে থাকে, আপনি মারাত্মক শারীরিক এবং মানসিক অসুখের শিকার হতে পারেন।

চট করে তৈরি করে ফেলা যায়—স্ট্রেসজনিত এমন অসুখের তালিকায় রয়েছে : হার্ট ডিজিজ, হাইপারটেনশন, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, স্ট্রোক, আইবিএস, আলসার, ডায়াবেটিস, মাসল ও জয়েন্ট পেইন, এলার্জি, মিসক্যারেজ, এমনকি হাস্যকর শোনালেও—অকালে দাঁত পড়া।

অনেক উৎস থেকে স্ট্রেস আসতে পারে—বাইরের পরিবেশ, পরিবার, বন্ধু বা পরিচিত গন্ডি, পেশাগত ক্ষেত্র, সামাজিক ক্ষেত্র। তবে উৎস যা-ই হোক, স্ট্রেসের কারণ মূলত চারটি : পণ্যদাসত্ব, পণ্যঋণ, বিপদের কল্পনা এবং বয়ে বেড়ানো।

প্রথমেই আসা যাক পণ্যদাসত্বের কথায়। আধুনিক পুঁজিবাদী সভ্যতায় পণ্য বা ক্রয়ক্ষমতাকেই আমরা মনে করি সাফল্যের মাপকাঠি। কে কত দামি জিনিস কিনতে পারে, কে কত বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারে তা দিয়েই আমরা মানুষের গুরুত্ব মাপতে চেষ্টা করি। ফলে সম্পদ আহরণ বা পণ্য কেনার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত অধিকাংশ মানুষ। কিন্তু পণ্যের প্রকৃতি হচ্ছে—যতই কেনা হোক, আরো কেনার অভাববোধ কখনো ফুরায় না।

আমেরিকার ধনকুবের জন ডি রকফেলারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, What is enough? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, Just one more. অর্থাৎ পণ্য বা সম্পত্তি বা ভোগের উপকরণের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এক অনন্ত অভাববোধের দুষ্টচক্রে আবর্তিত হওয়া। আর এর ফলে তৈরি হয় প্রতিযোগিতা/ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতা। যার পরিণাম স্ট্রেস। কারণ পণ্য আরাম দিতে পারে, কিন্তু প্রশান্তি দিতে পারে না। টাকা দিয়ে বিছানা কেনা যায়, ঘুম নয়। টাকা দিয়ে খাবার কেনা যায় কিন্তু ক্ষুধা বা খেতে পারার সামর্থ্যকে নয়। টাকা দিয়ে প্রাসাদ কেনা যায়, কিন্তু শান্ত-সুখের নীড় নয়।

অশান্তির দুই নম্বর কারণ হলো ঋণ। পণ্যঋণ। আধুনিককালে ব্যাংকগুলো ভোক্তাদের নানা ধরনের পণ্যঋণের অফার দিচ্ছে। টিভি, ফ্রিজ থেকে শুরু করে ছেলে-মেয়ের বিয়েও যাতে তাদের কাছ থেকে ঋণ করে দিতে হয় সেজন্যে তাদের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের শেষ নেই। সাধারণ মানুষও আধুনিক (!) লাইফ স্টাইলের আকর্ষণে পা দিচ্ছে ঋণ নামক এসব দুষ্ট চক্রের ফাঁদে। আর পরিণামে নিয়ে আসছে নিজের ওপর এক অপরিমেয় অশান্তি, টেনশন আর অস্থিরতার খড়গ। ঋণের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, একবার যদি আপনি ঋণগ্রস্ত হন তবে ক্রমাগত তা বাড়তেই থাকবে। প্রথমে হয়তো টিভি কেনার জন্যে ঋণ নিলেন, তারপর এসি, তারপর গাড়ি, তারপর বাড়ি, তারপর ছেলে-মেয়ের বিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঋণ থেকে যে টেনশন তা থেকে যে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, মাইকেল জ্যাকসনই তার প্রমাণ। ২০০৯ সালে আকস্মিক এক কার্ডিয়াক এরেস্টে যখন তিনি মারা যান তখন তার অপরিশোধ্য ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলার যা পরিশোধের চেষ্টা করতেই তিনি অসুস্থতা সত্ত্বেও লন্ডনে কনসার্ট আয়োজনের প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন। কিন্তু টেনশন কমাতে দীর্ঘদিন ধরে তিনি যে পেইনকিলারে আসক্ত ছিলেন তা-ই তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

আর ঋণজনিত টেনশনের ফলে মানুষ তার স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে নিজেকে কত বিব্রতকর অবস্থায় ঠেলে দেয় তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো বৃটেনের রাজপুত্র এন্ড্রুর সাবেক স্ত্রী সারা ফার্গুসন। সম্প্রতি বৃটেনের একটি ট্যাবলয়েডে প্রকাশিত হয় যে, ডাচেস অফ ইয়র্ক সারা ফার্গুসন তার সাবেক স্বামী প্রিন্স এন্ড্রুর সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবেন এ প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ পাউন্ড দাবি করছেন। এবং গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবিতে দেখা যাচ্ছে, যে রিপোর্টার ব্যবসায়ী সেজে ফার্গুসনের সাথে এ কথোপকথন করছেন তিনি তার হাতে আগাম ৪০ হাজার ডলার তুলে দিচ্ছেন।

তিন নম্বর হলো, স্ট্রেসের কারণ ঘটনা নয়, ঘটনার প্রেক্ষিতে সৃষ্ট মানসিক প্রতিক্রিয়া। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। দুজন মহিলা মুখোমুখি দুটি রিকশায় যাচ্ছিলেন। প্রথম রিকশায় একজন মহিলা একাই ছিলেন। উল্টোদিকের রিকশায় ছিলেন এক মহিলা এবং তার চার বছর বয়সী মেয়ে।

প্লে-গ্রুপে পড়া মেয়েটিকে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরছিলেন তিনি। দুটি রিকশা যখন মুখোমুখি তখন ঘটল একটা ছোট্ট ঘটনা। মা-মেয়ের রিকশা দ্রুত আসতে গিয়ে চলন্ত এক বাসের সাথে ধাক্কা লেগে খানিকটা কাৎ হয়ে আবার সোজা হয়ে গেল। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মা শক্ত করে রিকশার হুড ধরে ফেললেন। রিকশা আবার চলতে শুরু করল।

ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু হলো না। কারণ পাশের রিকশায় যিনি ছিলেন তিনি দূর থেকে পুরো ঘটনাটা দেখলেন এবং এরপর নিজের কল্পনাশক্তিকে প্রয়োগ করে ভাবতে লাগলেন যদি রিকশাটা কাৎ হয়ে পড়ে যেত, তাহলে কী হতো? যদি মেয়েটি ছিটকে পড়ত তাহলে কী হতো? মেয়েটির ওপর দিয়ে যদি বাসটা চলে যেত, তাহলে কী হতো? এত ছোট মেয়ে—মারা গেলে মায়ের কী অবস্থা হতো? অথবা মা-ও তো পড়ে আহত হতে পারতেন বা মারা যেতে পারতেন। তখন মেয়েটির কী হতো? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে মহিলা নিজেই অসুস্থ হয়ে গেলেন। অথচ বাস্তব ঘটনা কিছুই না, এমনকি যাদের নিয়ে এত উদ্বেগ তাদেরও কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না, মাঝখান থেকে বিপদের কল্পনা করতে করতে অসুস্থ হয়ে গেলেন তৃতীয় একজন ব্যক্তি।

আর চার নম্বর কারণ হলো, বয়ে বেড়ানো। আমরা অধিকাংশ সময় ছোটখাটো ঘটনা বা প্রতিক্রিয়াগুলোকে বয়ে বেড়াই। ফলে যে বিষয়গুলোকে সহজেই ক্ষমা করে দিতে পারতাম বা এড়িয়ে যেতে পারতাম তা করতে পারি না এবং পরিণামে স্ট্রেসড্ হই।

দুই ভিক্ষুর গল্পে এ বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। বয়সে নবীন এবং প্রবীণ দুই ভিক্ষু জঙ্গলের পথ দিয়ে আশ্রমে ফিরছিলেন। প্রায় যখন সন্ধ্যা, হঠাৎ দুজনই দেখলেন, নির্জন জঙ্গলের পাশে খরস্রোতা এক নদী, তার সাঁকোর গোড়ায় একা বসে আছে এক তরুণী। মেয়েটি জানাল, আত্মীয়ের বাড়ি থেকে নিজের গ্রামে ফিরছে সে। কিন্তু ভরা জোয়ারের এই সময় একা এই সাঁকো পেরোতে সে ভয় পাচ্ছে। এজন্যে বসে আছে।

প্রবীণ ভিক্ষু কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। ভিক্ষুদের আচরণবিধি অনুসারে কোনো ভিক্ষুর পক্ষে নারীস্পর্শ মহাপাপ। কিন্তু এই তরুণীকে যদি একলা এখানে রেখে তারা চলে যান তাহলে এই রাতে মেয়েটির জীবন বা সম্ভ্রম বিপন্ন হওয়ার যে ঝুঁকির মধ্যে তাকে ফেলে যাওয়া হবে সেই পাপ হবে আরো বড়। প্রবীণ ভিক্ষু সিদ্ধান্ত নিলেন এবং হাত ধরে তাকে পার করে দিলেন।

সাঁকো পেরিয়ে আবার দুই ভিক্ষু পথ চলতে লাগলেন। এবার নবীন ভিক্ষু মুখ খুললেন, গুরু, এ আপনি কী করলেন? নারীস্পর্শের মতো মহাপাপ করে ফেললেন? আপনার এখন কী হবে গুরু? এভাবে সারাপথই সে বকতে লাগল। প্রবীণ ভিক্ষু কিছুই বলছেন না।

অবশেষে যখন আশ্রমের দরজায় এসে থামলেন, প্রবীণ ভিক্ষু তখন বললেন, দেখ, আমি তো ঐ তরুণীকে ঐ সাঁকোর পারেই রেখে এসেছি। কিন্তু তুমি তো তাকে এখনো বয়ে বেড়াচ্ছো। পাপ তাহলে কার বেশি হবে, আমার না তোমার?

আমরাও আমাদের জীবনের দিকে তাকালে দেখব—এরকম অনেক বিষয়ই আছে যা আমরা ওভারলুক করতে পারলে আমাদের জীবন অনেক বেশি সহজ, স্ট্রেসমুক্ত হতে পারত।

তথ্যসূত্রঃ প্রশ্নোত্তর | কোয়ান্টাম মেথড

Skip to content