বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই ভিতের একটি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। অথচ রেমিট্যান্সের কারিগররাই দেশে-বিদেশে নানা হয়রানি, বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার হন। দেশে দালাল ও বিদেশে এজেন্সির লোকদের প্রতারণা ও হেনস্তার শিকার হয়ে অনেকেই দেশে ফেরেন কপর্দকশূন্য হয়ে। এতে তাদের পরিবার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি রাষ্ট্র বঞ্চিত হয় কাঙ্ক্ষিত রেমিট্যান্স থেকে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কাজ না পেয়েই ফেরত আসছেন ৩৫ শতাংশ কর্মী। শ্রমশক্তি রফতানিতে যে বড় আকারের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে এ প্রতিবেদনে তা স্পষ্ট। কোনো ধরনের কাজ নিশ্চিত না করে কেন শ্রমিক পাঠানো হবে? আবার প্রতিষ্ঠান কোন কোন দক্ষতার শ্রমিক চাচ্ছে তা স্পষ্ট না করে কেন ভিসা ইস্যু করে? সংকটের এ দুই দিক সামনে রেখে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
২০২০ সালের পর বিদেশে গিয়ে ফিরে আসা ২১৮ কর্মীর ওপর জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে রামরু। এ কর্মীদের মধ্যে ৪২ জন নারী। গত অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে এ জরিপ চালায় তারা। নানা কারণে কর্মীরা দেশে ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছে রামরুর প্রতিবেদন। এতে বলা হয়, কাজ না পেয়ে ফিরে এসেছেন একটি বড় অংশ। এর মধ্যে বিদেশে গিয়ে কোনো কাজ পাননি ১৫ শতাংশ কর্মী। আর ২০ শতাংশ কর্মী তাদের চুক্তি অনুসারে কাজ পাননি। কম বেতনের জন্য ফিরেছেন ১৪ শতাংশ কর্মী। আটক হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন ১৬ শতাংশ কর্মী। বৈধ ভিসা না থাকায় সাড়ে ১০ শতাংশ ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে ফিরে এসেছেন ১২ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মী।
নানা সংকটের মধ্যেও শ্রম অভিবাসনে বড় এক মাইলফলক অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে টানা দুই বছরে ১০ লাখ ছাড়িয়েছে জনশক্তি রফতানি। ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ ৯৯ হাজার বাংলাদেশী কর্মী বিদেশমুখো হয়েছেন। গত বছরের রেকর্ডসংখ্যক ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী রফতানির ধারাবাহিকতা এ বছরেও দেখা যাচ্ছে।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বলছে, মহামারীর কারণে দুই বছর বিদেশে যেতে না পারা অনেক শ্রমিকই ২০২২ ও ২০২৩ সালে গেছেন। এ সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে থাকায় তাদের চাকরির বাজারও উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি সব ধরনের সৌদি প্রতিষ্ঠানে অভিবাসী বাংলাদেশীদের জন্য নির্ধারিত কোটা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করার ঘটনাও অবদান রেখেছে রেকর্ড এ প্রবৃদ্ধিতে। বাংলাদেশী শ্রমিকদের শীর্ষ গন্তব্য সৌদি আরব। এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ৩৭ শতাংশই হয়েছে উপসাগরীয় দেশটিতে। তার পরই রয়েছে মালয়েশিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, কাতার, কুয়েত ও জর্ডান। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানি শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। ওই বছর ৬ হাজার ৮৭ জন কর্মী বিদেশে যান। তার পর থেকে প্রায় প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়মিত জনশক্তি রফতানি হচ্ছে।
শুধু সংখ্যায় প্রবৃদ্ধিই পর্যাপ্ত নয়, দক্ষ শ্রমিক পাঠানো জরুরি। কারণ একজন দক্ষ শ্রমিক ডজনখানেক অদক্ষ শ্রমিকের চেয়ে বেশি আয় করতে পারে। শুধু কায়িক শ্রমনির্ভর খাতগুলোতেই বাংলাদেশী শ্রমিকদের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। মেধানির্ভর খাতেও লোক পাঠানোয় জোর দিতে হবে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) এক তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ থেকে যতসংখ্যক লোক বিদেশে গমন করে তাদের মাঝে চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা পেশাদার লোকের সংখ্যা মাত্র ২ শতাংশ। তাদের বেতন পরিশোধের ধরন শ্রমিকদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাস শেষে তাদের বেতন পরিশোধ করা হয়। শ্রমিকদের মাঝে বিশেষ করে নির্মাণ শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, কোন প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক কর্মী, রেস্টুরেন্ট কর্মী, ড্রাইভার এসব মূল ধারার কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিকদের দিনভিত্তিক কাজের বিনিময়ে টাকা প্রদান করা হয়। ফলে তাদের চাকরি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনিশ্চয়তার মাঝে আটকে আছে। তাই এসব প্রবাসী বিদেশে যেতে না পারলে আমাদের দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দারিদ্র্য হ্রাসে ভূমিকা রাখে এবং জিডিপির স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে।
হঠাৎ করেই দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা যায় না এবং পাঠানো যায় না। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে নিরাপদ শ্রমশক্তি রফতানি করতে হবে। এরই মধ্যে প্রবাসে যেসব শ্রমিক কাজ করছেন তাদেরও কীভাবে আরো দক্ষ করা যায়, ভালো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া যায় সে প্রয়াস জারি রাখতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় সরকারকে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা এবং সেখানে বৈধভাবে বসবাসকারীদের ফেরত না পাঠানোর জন্য লবিং জোরদার প্রয়োজন। যেসব বাংলাদেশী প্রবাসীর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে অথবা আকামার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদের ভিসা/আকামার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কোনো কর্মী বিদেশে চাকরিচ্যুত হলে অথবা নিয়োগকারী কোম্পানি যদি কর্মী ছাঁটাই করে, সেক্ষেত্রে তাদের দেশে না পাঠিয়ে সে দেশের অন্য কোনো কোম্পানিতে নিয়োগে লবিং করা যেতে পারে। একই সঙ্গে ফেরত আসাদের কীভাবে সহায়তা দেয়া হবে, তারও একটি পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ এখন অবৈধ ও অনেক বৈধ শ্রমিককে ফেরত পাঠাতে তৎপর। এ অবস্থায় বৈধদের সংশ্লিষ্ট দেশে রাখতে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি যাদের কাজের বৈধতার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে, সেগুলো নবায়ন করার উদ্যোগও নিতে হবে। অবৈধ এবং যাদের প্রবাসে আর থাকার সুযোগ নেই, তাদের ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করতে হবে। এজন্য প্রথমেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে।
অনেক নারী শ্রমিক নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়ে কারো সহায়তা না পেয়ে নীরবে নিভৃতে দেশে ফিরে এসেছেন। ২০২২ সালের শেষের দিকে রামরুর আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭-২১ এ পাঁচ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৫ হাজার ৩৬৮ বাংলাদেশী অভিবাসী মারা গেছেন। তাদের মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই আত্মহত্যা করেছেন ৫০ নারী অভিবাসী। এ চিত্র নিশ্চয়ই সুখকর নয়! তবে নারী নির্যাতনের চিত্রটা ভয়াবহ সৌদি আরবেই। দৈহিক নির্যাতন, ধর্ষণ, পাশবিক নির্যাতন—এ রকম শত শত অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বেশির ভাগ নারী শ্রমিকের কর্মস্থল হলো সৌদি আরব। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশের মেয়েদের পূর্ণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত হয়নি। সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসসংলগ্ন সেফ হোমে নির্যাতিত নারী শ্রমিকের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নির্যাতিত নারীরা সেফ হোমে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। সৌদি আরব, জর্ডানসহ কয়েকটি দেশ থেকে নির্যাতনের কারণে অনেক নারী শ্রমিককে মৃত্যুর মুখ থেকে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হতে হয়েছে।
কোনো অভিবাসী শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হলে তার সুবিচার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। দুঃখজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশের শ্রমিকরা অবিচারের শিকার হলেও সরকার সবসময় তার প্রতিকার নিশ্চিত করতে পারছে না। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় না থাকার কারণে অভিবাসী কর্মীরা নির্যাতন ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। মামলা করলেও সুবিচার পাচ্ছেন না। অভিবাসীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে এ-সংক্রান্ত কাজ প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হাতে নিতে হবে। অন্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। এক ছাদের নিচে আমরা যদি সব সেবা না দিতে পারি, তাহলে মন্ত্রণালয় ভালোভাবে কাজ করতে পারবে না।
মনে রাখতে হবে, পরিবারে সমৃদ্ধি আনতে অনেকেই শেষ সম্বল জায়গাজমি বিক্রি করে কিংবা টাকা ধার করে বিদেশ গমনের প্রস্তুতি নেয়। এসব শ্রমিকের প্রেরিত রেমিট্যান্সের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে ঋণ পরিশোধ করা। তাই তাদের জন্য এ প্রত্যাগমন অতিকষ্টেরই বটে। যারা চলে এসেছেন তাদের জন্য নতুন শ্রমবাজার তৈরি করা কষ্টসাধ্য। অন্যদিকে বেকার সমস্যার এ সময়ে বাজারে শ্রমশক্তি উদ্বৃত্ত। প্রবাসীরা এ সংকটকালীন মুহূর্তে দেশে ফিরে আসায় এক ধরনের বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। এ বিপুলসংখ্যক লোকের কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেয়া অসম্ভবই বটে। তবে ফেরত আসা অভিবাসীরা যদি সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার আওতাভুক্ত না হন এবং বিদেশে এসব অভিবাসীকে পুনরায় পাঠানো না যায় তবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর অতি নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। বছরে কত কর্মী পাঠানো হলো তা নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর গিললে হবে না, বরং গুণগত অভিবাসনে জোর দেয়াই কাম্য।
Related Posts
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আন্তর্জাতিক আস্থা তৈরি করতে হবে
ব্যাংক খাতে অর্থ লোপাট দ্রুত সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে
পাটপণ্যের রপ্তানিমূল্য মিলের ব্যাংক হিসাবে পাঠানোর নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের